পূর্ব তিমোর স্বাধীন হল

রবি শংকর চাকমা

পূর্ব তিমুর পতাকা

৩০ আগস্ট ১৯৯৯ গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত পূর্ব তিমোর ছিল ইন্দোনেশিয়ার দখলাধীন। তারও আগে সাড়ে ছয় লক্ষ জনসংখ্যা অধ্যুষিত (পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনসংখ্যার সমান) এই অঞ্চলটি ছিল পর্তুগালের একটি উপনিবেশ। ১৭০২ সালে সরাসরি প্রশাসন হাতে নিলেও, পূর্ব তিমোরের সাথে পর্তুগালের সম্পর্ক স্থাপিত হয় ১৫১২ খ্রীষ্টাব্দে। বর্তমানে পূর্ব তিমোর দ্বীপটির পূর্বাংশের ১২টি জেলা, পশ্চিম পাশের্^ আমাবেনো জেলা এবং জেকো (Jako) আতাউরো (Atauro) দ্বীপ নিয়ে গঠিত। পূর্ব তিমোরের ভাষা, ধর্ম উপনিবেশিক ইতিহাস ঐতিহ্য ইন্দোনেশিয়া থেকে ভিন্ন।

১৭ শতক থেকে নেদারল্যান্ড পর্তুগাল তিমোরের দখলদারিত্ব নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে। এর ফল হিসেবে তিমোর দ্বীপটি দুই ভাগ হয়ে যায়। পশ্চিমাংশ নেদারল্যান্ড দখল করে নেয় এবং ডাচ ইন্ডিজের অংশ হয়। তিমোরের পূর্বাংশ বা পূর্ব তিমোর পর্তুগালের অধীনে চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ডাচ ইন্ডিজ ইন্দোনেশিয়া নামে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে, পশ্চিম তিমোর নতুন দেশের একটি অংশ হিসেবে থেকে যায়। কিন্তু পূর্ব তিমোরে পর্তুগালের দখলদারিত্ব বলবৎ থাকে।

১৯৭৪ সালে পর্তুগালের ক্যূদেতার পর, সে দেশের সরকার পূর্ব তিমোরের উপনিবেশ ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। তখন দ্বীপপুঞ্জ কলোনীতে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি কর্মসূচি নিয়ে তিনটি রাজনৈতিকগ দল গড়ে উঠে। এগুলো হচ্ছে ঘহরধড় Nniao Democratica de Timor (UDT) (ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন অব তিমোর বা ইউডিটি), Frente Revolutionaria de Timor Leste Independente (FRENTILIN  রেভ্যুলশনারী ফ্রন্ট ফর ইন্ডিপেন্ডেট ইস্ট তিমোর বা ফেটিলিন) এবং Associacao Popular Democratica de Timor (APODETI) (পপুলার ডেমোক্রেটিক এসোসিয়েশন অব তিমোর বা এপোডেটি) ইউডিটি মূলত পর্তুগালের শাসন অব্যাহত রাখার পক্ষে। তবে পরের দিকে দলটি স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়। অপরদিকে ফ্রেটিলিন পূর্ণস্বাধীনতার পক্ষে এবং এপোডেটি মনে করে যে, পূর্ব তিমোর স্বাধীনভাবে টিকতে পারবে না, সেজন্য দলটি ইন্দোনেশিয়ার সাথে সংযুক্ত হওয়ার পক্ষে ওকালতি করে।

তিনটি দলের মধ্যে ইউডিটি প্রথমদিকে বেশ শক্তিশালী হলেও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সাথে তাদের সম্পর্ক প্রথমদিকে স্বাধীনতা দাবির প্রতি অনাগ্রহের কারণে তাদের বহু সমর্থক ফ্রেটিলিন-এর দিকে ঝুঁকে পড়ে। ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকেই ফ্রেটিলিন পূর্ব তিমোরীদের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। এপোডেটি ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকে।

উপরোল্লেখিত তিনটি প্রধান দল ছাড়াও আরও কিছু ক্ষুদ্র আকারের পার্টি গড়ে ওঠে, তবে তাদের প্রভাব ছিল অত্যন্ত নগণ্য।

১৯৭৪ সালের নভেম্বরে পর্তুগাল সরকার পূর্ব তিমোরের জন্য নতুন গভর্ণর নিয়োগ দেন। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে সরকারি পরামর্শ পরিষদ (Advisory Goverment Council) গঠন করেন। প্রথমে এপোডেটি পরে ফ্রেটিলিন এতে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে ইউডিটি ফ্রেটিলিন স্বাধীনতার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়।

কলোনী বিমুক্তকরণ আলোচনা ইন্দোনেশিয়ার হস্তক্ষেপ:

১৯৭৫ সালের মে মাসে পর্তুগাল কলোনী বিমুক্তকরণ (decolonisation) সংক্রান্ত আলোচনা শুরু করে। ফ্রেটিলিন এপোডেটি বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা বয়কট করে। পরে পর্তুগাল সরকার ১৯৭৬ সালের অক্টোবর মাসে গণ পরিষদের (Popular Assembly) নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা করে। ফ্রেটিলিন তার রাজনৈতিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি করে দেয় এবং ইউডিটি ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট রাজধানী দিলির গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ভবনের দখল নেয়। তারা অচিরেই স্বাধীনতা প্রদান এবং ফ্রেটিলিন নেতাদের গ্রেফতারের দাবি জানায়। কিন্তু পর্তুগাল সরকার এসব দাবি প্রত্যাখ্যান করে এবং আলোচনায় ফিরে আসার আহ্বান জানায়। এদিকে ফ্রেটিলিন ইউডিটি-এর মধ্যে ভয়াবহ আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, যাতে ৩০০০ থেকে ৬০০০ লোক মারা যায় বলে অনেকের ধারণা। স্থানীয়ভাবে সংহীত পর্তুগালের সৈন্যরা বিশৃংখল হয়ে পড়লে এদের বেশীর ভাগ অংশ ফ্রেটিলিন-এর সাথে যোগ দেয়। দিলিতে পর্তুগালের শাসকরা আতাউরো দ্বীপে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন এবং পরে ডিসেম্বরে সেখান থেকেও চলে যান।

১৯৭৫ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে ফ্রেটিলিন অন্যান্য দলগুলোর চাইতে যথেষ্ট শক্তি অর্জন করে এবং তারা এলাকায় তাদের নিজস্ব প্রশাসন কায়েম করতে সমর্থ হয়। ফ্রেটিলিন বছরের ২৮ নভেম্বর একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ইউডিটি এপোডেটি এর পাল্টা হিসেবে ইন্দোনেশিয়ার সাথে সংযুক্তির ডাক দেয়।

১৯৪৫ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই ইন্দোনেশিয়া পূর্ব তিমোরের ওপর কোন প্রকার দাবি উত্থাপন করেনি। এমনকি ইন্দোনেশিয়া দিলিতে ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত একটি কনস্যুলেট চালু রাখে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে লিসবন উপনিবেশ গুটিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে সুহার্তো সরকার পূর্ব তিমোর দখল করে নেয়ার সুযোগ হাতে পায়। ইন্দোনেশিয়া প্রথমে একটি ক্যু প্রচেষ্টা সমর্থন করার মাধ্যমে দ্বীপটির স্বাধীনতায় বাধা দেয়। কিন্তু এই ক্যু ব্যর্থ হলে বছরের ৭ই ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনী পূর্ব তিমোর দ্বীপপুঞ্জ জোরপূর্বক দখল করে নেয়।

আমেরিকার ভূমিকা:

ইন্দোনেশিয়া কর্তৃক পূর্ব তিমোর আক্রমণের কয়েক ঘন্টা আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার জাকার্তায় সুহার্তোর সাথে আলোচনায় মিলিত হন। কিসিঞ্জার পূর্ব তিমোরের ব্যাপারে উক্ত বৈঠকে আলোচনা হয়নি বলে দাবি করলেও পরে দেখা গেছে যে, তারা সুহার্তোকে আক্রমণের জন্য সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন। আক্রমণের সময় ইন্দোনেশিয়ার সৈন্যদের হাতে যে অস্ত্র ছিল তা ৯০ ভাগ হচ্ছে আমেরিকার তৈরি, যদিও আমেরিকা আইন অনুসারে তাদের সামিরক সাহায্য আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই আক্রমণের পর ইন্দোনেশিয়ায় আমেরিকার সামরিক অর্থনৈকি সাহায্য বহুগুণ বেড়ে যায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণকারী সহার্তো সরকারকে কূটনৈতিক সমর্থন দেয়। জিমি কার্টারের সময় এই সাহয্য আরো বেড়ে যায়। ৭৫ সালের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাকার্তার কাছে বিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া:

একমাত্র অস্ত্রেলিয়া ছাড়া বিশে্ব কোন দেশ পূর্ব তিমোরের ওপর ইন্দোনেশিয়ার সার্বভৌমত্ব আইনগতভাবে স্বীকার করেনি। অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোও নৈতিকতা সৌজন্যতার চাইতে ইন্দোনেশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক থেকে উদ্ভুত লাভকেই প্রাধান্য দেয়। অস্ত্র বিক্রির সম্ভাবনা, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ইন্দোনেশিয়ার মতো একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক রাখার ভৌগলিক অন্যান্য সুবিধা ইত্যাদি বিবেচনা ধনী দেশগুলোর পূর্ব তিমোর সম্পর্কিত নীতিতে প্রাধান্য পায়। পূর্ব তিমোরের তেল সম্পদ লুন্ঠনের উদ্দেশ্যে অস্ট্রেলিয়া ইন্দোনেশিয়াকে সামরিক সাহায্য প্রদান অব্যাহত রাখে এবং সরকারিভাবে পূর্ব তিমোরের ওপর ইন্দোনেশিয়ার সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়। বৃটেন, জার্মানী নেদারল্যান্ডও ইন্দোনেশিয়ায় অস্ত্র সরবরাহ করে। জাপন দেয় অর্থনৈতিক সাহায্য এবং কানাডা সামরিক অর্থনৈতিক উভয় রকম সাহায্য প্রদান করে।

জাতিসংঘের ভূমিকা:

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৭৫ সালের ২২ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার হস্তক্ষেপের নিন্দা জানিয়ে সর্বসম্মতভাবে একটি সিদ্ধান্ত পাস করে এবং বিশে্ব সকল রাষ্ট্রকে পূর্ব তিমোরের ভৌগলিক অখণ্ডতা তিমোরীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানায়। নিরাপত্তা পরিষদ ইন্দোনেশিয়াকে অচিরেই দখল ছেড়ে দেয়ারও আহ্বান জানায়। পরে ২২ এপ্রিল ১৯৭৬ অপর একটি সিদ্ধান্তে নিরাপত্তা পরিষদ একই দাবি পুনর্ব্যক্ত করে। যুক্তরাজ্য সহ ১২টি দেশ সিদ্ধান্তের পক্ষে ভোট দেয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপান ভোটদানে বিরত থাকে। তবে কোন দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়নি।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৮ সুহার্তের পতন পর্যন্ত পূর্ব তিমোর:

দখলের পর ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমোরে একটি অস্থায়ী সরকার খাড়া করে এবং ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই পূর্ব তিমোরকে ২৭তম প্রদেশ হিসেবে করে। অধিকৃত পূর্ব তিমোরে ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনী জনগণের ওপর অমানুষিক নিপীড়ন নির্যাতন চালায়। গণহত্যা, ধর্ষণ, গুপ্তহত্যা, গ্রেফতার, শারিরীক নির্যাতন, বিনা বিচারে আটক ইত্যাদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা হয় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে। তারা সেখারে গুচ্ছগ্রাম (strategic hamlet) সৃষ্টি করে, যার ফলে পূর্ব তিমোরীদের দুর্ভোগ বেড়ে যায় কৃষি কাজে বিঘ্ন ঘটায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। পূর্ব তিমোরে দলে দলে বহিরাগত ঢুকে পড়ে সরকারের আনুকূল্যে। ইন্দোনেশিয়া কর্তৃক দখলের পর পূর্ব তিমোরে টিক কত লোক মারা গেছেন তার কোন সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায় না। খোদ ইন্দোনেশিয়ানরা স্বীকার করে যে ৭০ দশকে ৮০ হাজার পূর্ব তিমোরী মারা গেছেন। অনেক এনজিও মনে করে আজ পর্যন্ত কমপক্ষে দুই লক্ষ লোক মারা গেছেন। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। তবে পর্তুগালের শেষ ইন্দোনেশিয়ার প্রথম আদমশুমারী তুলনা করে যে ৪০ হাজার লোক বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের হিসেব করে বলা যায় মৃতের সংখ্যা লক্ষের বেশি হবেই। জাস্টিস এবং পিস কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী কেবল ১৯৯৮ সালে ২১২টি গ্রেফতার, ৫৪টি খুন, ১৯টি গুম, ২৩৪টি ভয়ভীতি হুমকি প্রদান, ৮৯টি শারিরীক নির্যাতন, ১৪টি ধর্ষণ যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে এবং ১৫টি ভূমি সংক্রান্ত, ৩টি শ্রমিক সংক্রান্ত ১৬টি ঘরবাড়ি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ সংক্রান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হয়। অংকগুলো বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেক অনেক কম। কমিশন এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সেনাবাহিনী পুলিশ তাদের মদদপুষ্ট গোষ্ঠীদেরকে দায়ি করে।

ফ্রেটিলিন শহর ছেড়ে পাহাড়ে ঘাঁটি স্থাপন করে পূর্ব তিমোরকে ইন্দোনেশিয়ার দখল থেকে মুক্ত করার জন্য সেখান থেকে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করে। অচিরেই ২০০ জনের সশস্ত্র গেরিলা গ্রুপ থেকে তাদের শক্তি ২০০০ জনের সুসংগঠিত বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। তারা ব্যাপক জনগণের কাছ থেকে অকুণ্ঠ সমর্থন লাভে সমর্থ হয়।

১৯৮২ সালের পর ইন্দোনেশিয়া পূর্ব তিমোরীদেরহৃদয় মনজয় করার নীতি গ্রহণ করে এবং এলাকায় তথাকথিত অর্থনৈতিক সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যকলাপ বৃদ্ধি করে। কিন্তু পূর্ব তিমোরীদের অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৮৩ সালের পর নিপীড়নের মাত্রা কিছুটা কমে এলেও তা পরে আরও বেড়ে যায়। যেমন, ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে সুহার্তোর পূর্ব তিমোর সফরের প্রাক্কালে ব্যাপক ধরপাকড় হয়, ১৯৮৯ সালের অক্টোবর মাসে পোপের সফরের আগে পরে বহু লোককে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৯১ সালের ১২ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার সেনা সদস্যরা ফ্রেটিলিনের একজন শুভার্থীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় ২০০ জনকে হত্যা করে। ফ্রেটিলিন নেতা সানানা গুজমাও ১৯৯২ সালের নভেম্বরে গ্রেফতার হলে দলটি এক বিরাট ধাক্কা খায়।

২০ বছর ধরে পূর্ব তিমোরকে দখলে রাখতে পারলেও ইন্দোনেশিয়ার সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। ইন্দোনেশিয়ার অভ্যন্তরে সংকট ঘনীভূত হয়। ১৯৯৭ সালের মধ্যভাগে ইন্দোনেশিয়া সহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে অর্থনৈতিক সংকট প্রকটভাবে দেখা দেয়। ফলে পূর্ব তিমোরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া দখল বজায় রাখা অর্থনৈতিক দিক থেকে অলাভজনক হয়ে ওঠে। দেশের অভ্যন্তরের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সংকট নিরসন করতে সুহার্তো সরকার হিমশিম খেয়ে যায়। পূর্ব তিমোর তাদের জন্য একটি বাড়টি ঝামেলা বোঝা হয়ে দেখা দেয়। এই অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সংকটের মুখে সুহার্তো ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

পূর্ব তিমোরীদের সংগ্রাম:

পূর্ব তিমোরীরা দখলদার ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ২৫ বছর ধরে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম চালায়। তারা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, অহিংস প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠিত করে এবং পরোক্ষ প্রতিরোধের কৌশল প্রয়োগ করে। ছাত্র, ক্যাথলিক চার্চ এবং সাধারণ জনগণ কোন না কোনভাবে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়। কেউ সরাসরি অস্ত্র হাতে নিয়ে, কেউ গেরিলাদের খাদ্য যুগিয়ে, সমাবেশে অংশ নিয়ে বা পার্টি কর্মিদেরকে শত্রুর কাছ থেকে লুকিয়ে রেখে আন্দোলনে সহায়তা দেয়। ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনীর চরম অমানবিক নির্যাতন সত্বেও এবং বিরাট সংখ্যক সেটলারদের পূর্ব তিমোরে নিয়ে এলেও, তিমোরবাসীরা তাদের স্বাধীনতার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিজ্ঞা থেকে বিচ্যুত হননি। ফ্রেটিলিন মাউবেরি (maubere) জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেত তিমোরীদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালায়। মাউবেরি হচ্ছে একটি পর্তুগীজ শব্দ, যা দরিদ্র, পশ্চাদপদ কৃষকদের বোঝাতে তুচ্ছার্থ ব্যবহৃত হতো।

আন্তর্জাতিক কার্যক্রম:

প্রথমদিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে তিমোরীদের তেমন কার্যক্রম ছিল না। ইংল্যাণ্ড অস্ট্রেলিয়ায় কিছু গ্রুপ সমস্যাটির পতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালাতো। ৮০ দশকে এই কার্যক্রম কিছুটা বেড়ে যায়। তবে রাজধানী দিলি গণহত্যার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমেরিকার ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এমি গুডম্যান এবং এ্যালন নের্ইন এবং একজন ব্রিটিশ টিভি ফটো সাংবাদিক গণহত্যার ঘটনা প্রচার করে। সাথে সাথে চার্চ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো তৎপর হয়ে ওঠে।

Charlie Scheiner (চার্লি সেইনার)) East Timor Action Network গঠিত হয়। ১৯৯৬ সালে পূর্ব তিমোরের প্রধান আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি Jose Ramos Horta Ges Bishop Carlos Filipe Ximenes Belo নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলে পূর্ব তিমোরের প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ বহুগুণ বেড়ে যায়।

জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গণভোট: স্বাধীনতার প্রতি জনগণের রায়

১৯৯৮ সালের মে মাসে সুহার্তোর পতনের পর হাবিবি ক্ষমতা গ্রহণ করলে পূর্ব তিমোর সম্পর্কিত ইন্দোনেশিয়ার পলিসিতে পরিবর্তন আনা হয়। ১৯৯৯ সালের মে মাসে পর্তুগাল, ইন্দোনেশিয়া জাতিসংঘের মহাসচিবের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যাতে স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে পূর্ব তিমোরীদের মতামত গ্রহণের শর্ত থাকে। এরপর গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য পূর্ব তিমোরে জাতিসংঘের সাহায্য মিশন (UN Assistance Mission in East Timor or UNAMET) পাঠানো হয়।

গণভোটের প্রস্তুতি চলতে থাকলে, ইন্দোনেশিয়ায় কট্টরপন্থীরা তৎপর হয়ে ওঠে। তারা হাবিবির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠাপোষকতায় ইন্দোনেশিয়াপন্থী মিলিশিয়াদের আবির্ভাব ঘটে। তারা স্বাধীনতাপন্থীদের ওপর সহিংস হামলা চালায়, হত্যা ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। এদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সত্বেও, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গত বছর ৩০ আগস্ট পূর্ব তিমোরে শান্তিপূর্ণভাবে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ভোট দানে যোগ্য প্রায় ৯৮ শতাংশ লোক গণভোটে অংশগ্রহণ করে এবং তাদের মধ্যে ৭৯ শতাংশ ইন্দোনেশিয়ার অধীনে স্বায়ত্তশাসনের বিপক্ষে ভোট দেয়।

নির্বাচর পূর্ব উত্তর সহিংসতা:

ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট মিলিশিয়ারা নির্বাচনের আগে থেকে সহিংস কার্যকলাপ শুরু করে দেয়। নির্বাচনে তিমোরী জনগণ সুস্পষ্টভাবে স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব নাকচ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিলে তারা আরও বেশি সহিংস হয়ে ওঠে। হত্যা, গুপ্ত হত্যা, গ্রেফতার, হুমকি ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ইন্দোনেশিয়াপন্থী মিলিশিয়ারা অস্ত্রের মুখে ৬০ হাজারের অধিক লোকজকে পশ্চিম তিমোরে নিয়ে যায়। শত শত নিরীহ লোককে হত্যা করে। ঘরবাড়ি ¦ালিয়ে দেয়। লোকজন ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে জঙ্গলে পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। ফ্রেটিলিনের প্রধান নেতা সানানা গুজমাও তার দলের গেরিলাদেরকে এই মিলিশিয়াদের হত্যাযজ্ঞ আক্রমণ প্রতিরোধ না করে ব্যারাকে নিষ্ক্রিয় থাকার নির্দেশ দেন। ফলে ইন্দোনেশিয়াপন্থী মিলিশিয়ারা তাদের অপকর্ম নির্বিঘ্নে চালাতে সক্ষম হয়। পরে ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ অস্ট্রেলিয়ার নেতৃত্বে জাতিসংঘ বাহিনী পূর্ব তিমোরে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় মিলিশিয়াদের নিরস্ত্র করে।

পূর্ব তিমোরীদের ভবিষ্যত:

পূর্ব তিমোর হচ্ছে পৃথিবীর দরিদ্রতম, অনুন্নত পশ্চাদপদ অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি। পর্তুগীজের শাসনাধীনের শেষ দিকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তিমোরীদের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৩৫ বছর, শিশু মৃত্যুর হার ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ। ৫০, ৬০ দশকে ছেলেমেয়েদের মাত্র % স্কুলে পড়াশুনার সুযোগ পেত। অশিক্ষার হার ছিল ৯৫-৯৯ শতাংশ। ৭০ দশকে কিছু স্কুল খোলা হয়, কিন্তু তা সত্বেও মাত্র ২০০০ জন ছাত্র সেখানে পড়ার সুযোগ লাভ করে। উচ্চ শিক্ষার জন্য কোন প্রতিষ্ঠান ছিল না। শ্রমিকদের মজুরী ছিল সপ্তাহে মাত্র অস্ট্রেলিয়ান ডলার। বিগত ২৫ বছরে ইন্দোনেশিয়ার শাসনামলেও এই পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন হয়নি। স্বাধীনতার লাভের পর সাধারণ তিমোরীদের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার মান কতটুকু বদলাবে তা আজ দেখার বিষয়। পূর্ব তিমোর মূলত প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। সেখানকার তেল গ্যাস সম্পদকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি আবর্তিত। শিল্পোন্নত কিছু দেশ যেমন তাদের স্বার্থে ১৯৭৫ সালে সুহার্তো সরকারের তিমোর আক্রমণকে মেনে নিয়েছিল বা সমর্থন করেছিল, বর্তমানেও একই কারণে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পূর্ব তিমোরের স্বাধীনতা লাভকে সমর্থন করছে। কারণ - National Council of Timorese Resistence -এর নেতা সানানা গুজমাও রামোস হোর্তা অস্ট্রেলিয়া তিমোর গ্যাস কন্ট্রাকটরদের নিশ্চয়তা দেন যে, স্বাধীনতার কারণে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ক্ষুন্ন তো হবেই না, বরং পূর্ব তিমোরের তেল সম্পদ উত্তোলনে অস্ট্রেলিয়াসহ কোম্পানীগুলোর অধিকারকে সমর্থন করা হবে।

তথ্যসূত্র:

1..East Timor: Historical Background, Foreign and commowelth Office. London, October 1999

2..Solidarity, The Newsletter of the Asian Human Rights Commission, April 1999, Vol. 9, No. 4 and October 1999 Vol 9 No.10

৩.ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য

4.বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য।


সূত্র:  স্বাধিকার, বুলেটিন নং ১৩, ৩০ জানুয়ারি ২০০০

 

Post a Comment

أحدث أقدم