![]() |
| ছবি: ইউপিডিএফ-এর রজত জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রতিবাদী গান পরিবেশন করছেন শিল্পীবৃন্দ |
আলোচনা সভা থেকে বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জাতি ও জনগণের ন্যায্য দাবি পূর্ণস্বায়ত্তশাসন অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইউপিডিএফ-এর পতাকা তলে সমবেত হয়ে আন্দোলন জোরদার করে সংগ্রামে অবিচল থাকার জন্য নেতা-কর্মী ও পার্বত্যবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
ইউপিডিএফ-এর দলীয় সঙ্গীত ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটি পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠান শুরু হয়। দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন শেষে ÒLong Long Long Live, UPDF UPDF,, পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম, চলছে চলবে” ইত্যাদি স্লোগানে মুখরিত হয় অনুষ্ঠানস্থল। এরপর ১৯৯৮-২০২৩ সাল পর্যন্ত জেএসএস (সন্তু), নব্যমুখোশ-সংস্কার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক শহীদ হওয়া ৩৫৬ জন ইউপিডিএফ এবং সহযোগী সংগঠন, শুভাকাঙ্ক্ষী, সমর্থকদের নাম তালিকা প্রকাশ করেন পিসিপির সাবেক সভাপতি সুনয়ন চাকমা। নাম প্রকাশ শেষে সকল শহীদদের শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। পরে অনুষ্ঠানে উপস্থিত গণসংগঠনের নেতা-কর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী, সমর্থকরা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই-সংগ্রামের অবিচল থাকার দৃঢ় অঙ্গিকার ব্যক্ত করে প্রতিজ্ঞা করেন। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করান ইউনাইটেড ওয়ার্কার্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউডব্লিউডিএফ)-এর সহ-সাধারণ সম্পাদক প্রমোদ জ্যোতি চাকমা।
![]() |
| ছবি: শহীদ হওয়া ৩৫৬ জন ইউপিডিএফ এবং সহযোগী সংগঠন, শুভাকাঙ্ক্ষী, সমর্থকদের নাম তালিকা প্রকাশ করছেন পিসিপির সাবেক সভাপতি সুনয়ন চাকমা। |
আলোচনা সভা পরিচালনা করেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ঢাকা শাখার সভাপতি নরেশ ত্রিপুরা।
আলোচনা সভায় ইউপিডিএফ-এর সভাপতি প্রসিত খীসা নেতা-কর্মী ও জনগণের উদ্দেশ্যে লিখিত বার্তায় বলেন, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিরোধ লড়াই সংগঠিত হয়েছে। বহিঃশক্তির আগ্রাসন প্রতিরোধ করে এ অঞ্চলের জনগণ নিজেদের স্বকীয়তা অক্ষুণ্ন রেখে গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তার ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর আবির্ভাব ঘটেছে ইউপিডিএফ-এর। জেল-জুলুম, মামলা-হুলিয়া, ষড়যন্ত্র-অপপ্রচার, গুপ্ত হামলা-হত্যা এককথায় অবর্ণনীয় দমন-পীড়ন মোকাবিলা করে ইউপিডিএফ ২৫ বছর ধরে অবিচলভাবে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই সংগ্রাম জারি রেখেছে। এ সংগ্রামে কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ের বেশ ক’জন সম্ভাবনাময় প্রতিশ্রুতিশীল সংগঠক-নেতা-কর্মীসহ ৩৫৬ জন আত্মবলি দিয়েছেন। এ স্মরণীয় দিনে বীর শহীদদের রক্ত পতাকা উর্ধ্বে তুলে এগিয়ে যাবার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করছি!
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে অতীতে বিভিন্ন সময়ে দালাল (‘দুলো’) বেঈমান আবির্ভূত হলেও সন্তু লারমার মতো কেউ এত ধূর্ততার সাথে আঁতাত করে সেনা-শাসকগোষ্ঠীর নীলনক্সা বাস্তবায়নে পারদর্শিতা দেখাতে পারেনি। কুসুমপ্রিয়-প্রদীপ লাল হত্যা (৪ এপ্রিল ১৯৯৮) থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ১১ ডিসেম্বর বিপুল-লিটন-সুনীল-রুহিন হত্যায় তার নির্দেশ ও সেনাদের সাথে যোগসাজশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ যাবৎকালে সন্তু লারমার মতো কেউ আর পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে এত ক্ষতি করতে পারেনি। তিনি হলেন সাক্ষাৎ মীর জাফর ও বিভীষণ। আন্দোলন গুটিয়ে অলিখিত চুক্তি ও আত্মসমর্পণ করে আঞ্চলিক পরিষদের গদি লাভের বিনিময়ে পাহাড়ের সংগঠন ও আন্দোলন ধ্বংস করেছেন। জনসংহতি সমিতি দু’বার (১৯৮২ ও ‘২০১০) ভেঙেছেন, প্রতিবাদী ছাত্রসমাজ মোকাবিলা করতে ছাত্রবেশী ধান্দাবাজদের মাস্তান-গুণ্ডা (৩০ জুন ১৯৯৭) বানিয়েছেন, পাহাড়ের সুবিধাবাদী দালালদের কুড়িয়ে নিয়েছেন। আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ইউপিডিএফ বরদাস্ত করবে না!
![]() |
| ছবি: প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ইউপিডিএফ-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি প্রসিত খীসার বার্তা পড়ে শোনাচ্ছেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের জিকো ত্রিপুরা |
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর অধিকাংশ কর্মকর্তা (মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম ব্যতিত) প্রকৃত সৈনিকের পক্ষে যে সব কাজ শোভা পায় না, অমর্যাদাকর, সে ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। এতে সৈন্যবাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি ভিতর থেকে ধ্বসে পড়েছে। পাকিস্তানের পাঞ্জাবি সৈনিকদের যোদ্ধা হিসেবে সুনাম থাকলেও পূর্ব বাংলায় পেশাদার সৈনিকের চরিত্র হারিয়ে, তাদের শোচনীয় হার হয়েছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রামেও নৈতিকভাবে অধঃপতিত সেনাবাহিনীর বড় অংশটি দেশের ক্ষতির কারণ হবে। দেশের অখণ্ডতা রক্ষা দূরের কথা, উগ্র সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও মানবাধিকার লংঘনের কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় জাতীয় বাহিনীর মর্যাদা হিসেবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নেই। গোটা দেশের জন্যই এরা বোঝা ও আপদ হয়ে দাঁড়াবে, দেশের গণতান্ত্রিক শক্তি সে আশঙ্কায় শঙ্কিত।
তিনি, জাতীয় সংকটময় পরিস্থিতিতে ইউপিডিএফ সময়োচিত ঘোষণা ও পদক্ষেপ গ্রহণে কখনই দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি। সকল ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ইউপিডিএফ অগ্রসর হয়েছে। অতীতের বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে, যারা ইউপিডিএফ-এর সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচির ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছে, তারা সরকার-শাসকগোষ্ঠীকেই লাভবান করেছে। ভবিষ্যতেও যারা ইউপিডিএফ-এর সময়োচিত আহ্বানে সাড়া দেবে না বা দোদুল্যমানতা দেখাবে, তারা সমাজ-জাতির ক্ষতির কারণ হবে বলে মন্তব্য করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী সকল শত্রুর হুমকি রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ইউপিডিএফ-এর পতাকাতলে সমবেত হয়ে ইউপিডিএফ-এর স্থানীয়ভাবে ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পড়ে লড়াই সংগ্রাম জোরদার করার আহ্বান জানান।
পিসিপির সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুরা কারাগারের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জাতি ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সংগ্রাম করতে গিয়ে ২২ মাস ৮ দিন কারাগারে বন্দি ছিলাম। এর আগে ২০১৩ সালে ৩৫ দিন কারাগারে থেকেছি। পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের ওপর সরকার-রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দমন নীতির অন্যতম কৌশল হচ্ছে হত্যা-গুম-খুন-অপহরণ, মিথ্যা মামলা দায়ের করে জেল-জুলুম ও নির্যাতন। এছাড়াও জাতি ধ্বংসের নীলনক্সা হিসেবে সাম্প্রাদায়িক হামলা, পাহাড়িদের ভূমি বেদখল, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ-খুন-হত্যা-অপহরণ ঘটনা ঘটিয়ে শাসক গোষ্ঠীর তাদের স্বার্থ আদায় করে।
তিনি আরো বর্ণনা দিয়ে বলেন, দীর্ঘ ২২ মাস ৮ দিন কারাগারে থাকাকালীন আমি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে পিছপা হইনি। আদর্শিক ছাত্র সংগঠনের একজন কর্মী হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছি। কারাগারে ভিতরে থাকা সহযোদ্ধাসহ সকল শ্রেণী মানুষের সাথে সংহতি বজায় রেখে চলেছি। কারাগারে বন্দীদের মধ্যে বয়স্ক, নারী-পুরুষ, অসহায় বন্দীদের মনোবল বৃদ্ধিসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। অনেকদিন ধরে একটি জায়গায় থাকাটা আসলে একজন মানুষের পক্ষে খুবই কষ্টকর। আমরা যেহেতু রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিয়োজিত তাই আমাদের পক্ষে এটি সম্ভব হয়েছে। কারাগারে থাকার সময় আমি যখন বাহির থেকে পাহাড়ের বিভিন্ন দুঃখজনক ঘটনার খবর পেতাম তখন নানা দুঃচিন্তায় পড়ে যেতাম। পরে বিশ্বের সফল বিপ্লবীদের সংগ্রামী জীবনের কথা স্মরণ করে মনকে দৃঢ় করে নিতাম, বই পড়তাম, ভিতরে সহযোদ্ধাদের সাথে সামগ্রিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতা সম্পর্কে আলোচনা করতাম। এভাবে নিজের ভিতরে সকল দুচিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলে নতুন ভাবনা নিয়ে কারাগারের দিনগুলো অতিবাহিত করেছি।
কারাগারে থাকাকালীন বাবার মৃত্যুর সংবাদের কথা স্মরণ করে অমল ত্রিপুরা বলেন, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ বাবা মারা যাওয়ার সংবাদ পরের দিন সকালে পেয়েছিলেন। সহযোদ্ধা প্রয়াত পুলক দা ও সুপার জ্যোতি দা আমাকে ডেকে নিয়ে বাবার মৃত্যুর সংবাদটি দিয়ে সমবেদনা জানালেন, তারা আমাকে বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে এমনটি পরামর্শ দিলেন। আমি তাঁদের কথা শুনার পর কিছুক্ষণ নীরব থেকে দাদাদের বললাম মারা গেছে ভাল হয়েছে। এমনিতে দীর্ঘ দিন ধরে বাবা অসুস্থ থেকে যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় ছিলেন। অন্ততপক্ষে সেখান থেকে সে মুক্ত হতে পেরেছিলেন। বাবার মৃত্যুর সংবাদে পিতৃহারা একজন সন্তানের এমন কথা হয়তো সেদিন অনেকেই অনেক কিছু মনে করেছিল। কিন্তু সে পরিস্থিতিতে বাস্তবে আমাকে এটা বলা ছাড়া আমার কোন পথ ছিল না। সে দিন এমনি করে আমি বাবা হারানো কষ্ট ও যন্ত্রণাকে নীরবে মেনে নিয়েছিলাম।
তিনি সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক আদালতের জামিনে কারামুক্তি বন্দিদেরকে জেল গেইট থেকে অন্যয়ভাবে পুনঃগ্রেফতারের বিষয়টিও তুলে ধরেন এবং এটি বন্ধের দাবি জানান।
তিনি দুঢ়তার সাথে বলেন, পাহাড়ে ছাত্র সমাজ শাসকের উৎপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, নিজেদের অধিকার বিষয়ে আরো সচেতন হবে, লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে নব্বই দশকে উত্তাল ছাত্র-গণ জোয়ারের চেতনায় উজ্জ্বীবিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠিত করবে। পাহাড়ি জনগণের অধিকার অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে।
তাঁর আলোচনা শেষে, প্রায় দুই বছর কারাগারে অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা “আমার কারাগারে জীবন” প্রবন্ধটি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে কারাগরে মারা যাওয়া শহীদ পুলক জ্যোতি চাকমা নামে উৎসর্গ করেন।
![]() |
| ছবি: আলোচনা সভায় বিপুল চাকমাসহ ৪জন সহযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ করছেন পিসিপি নেতা শুভাশীষ চাকমা |
তিনি বিপুল চাকমাসহ সকল শহীদদের স্বপ্ন ও চেতনার পথ বেয়ে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় আশা ব্যক্ত করেন |





Post a Comment