'পার্বত্য চুক্তি' বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ ও দুর্বলতাসমূহ

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যেকার স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তির আজ ২৬ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু সরকার এখনো এই চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেনি। দীর্ঘ ২৬ বছরেও চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। তবে মূল কারণ ও চুক্তির দুর্বলতার দিগগুলো এই লেখাতে তুলে ধরা হয়েছে:

ক । বাস্তবায়ন সংক্রান্ত দুর্বলতা

১) চুক্তির বাস্তবায়নের সময়সীমা ও রোড ম্যাপ না থাকা:

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো এই চুক্তি বাস্তবায়নের সময়সীমা ও রোড ম্যাপ না থাকা। এই সময়সীমা কেবল জনসংহতি সমিতির সদস্যদের অস্ত্র সমর্থনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। চুক্তির খ খ-ের ১২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘জনসংহতি সমিতি ইহার সশস্ত্র সদস্যসহ সকল সদস্যের তালিকা এবং ইহার আওতাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন অস্ত্র ও গোলাবারুদের বিবরণী এই চুক্তি স্বাক্ষরের ৪৫ দিনের মধ্যে সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও তার ভবিষ্যত নিকট দাখিল করিবেন।’ এরপর ১৩ ধারায় বলা হয়েছে : ‘সরকার ও জনসংহতি সমিতি যৌথভাবে এই চুক্তি স্বাক্ষরের ৪৫ দিনের মধ্যে অস্ত্র জমাদানের জন্য দিন, তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করিবেন।’

অপরদিকে সরকার কত দিনের মধ্যে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করবে তার কোন উল্লেখ চুক্তিতে নেই। সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার বিষয়ে খ খণ্ডের ১৭ (ক) ধারায় দায়সারাভাবে বলা হয়েছে:

‘সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি সই ও সম্পাদনের পর এবং জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিডিয়ার) ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলা সদরে তিনটি এবং আলীকদম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেওয়া হইবে এবং এই লক্ষ্যে সময়সীমা নির্ধারণ করা হইবে।’

তাই জনসংহতি সমিতি তাদের সকল অস্ত্র জমা দিলেও সরকার চুক্তির এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প আজও সরিয়ে নেয়নি। জেএসএস অস্ত্র জমা দেয়ার পর তার সকল leverage I bargaining power হারিয়ে ফেলে, চাকমা ভাষায় ‘দারভাঙা কাঙারা’ হয়ে যায় (দাঁড়া ভেঙে দিলে কাঁকরার যে অবস্থা হয়)। অপরদিকে সরকার জেএসএস-এর কাছ থেকে অস্ত্রগুলো জমা নেয়ার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, চুক্তি মোতাবেক ক্যাম্প সরিয়ে নেয়ার আর কোন বাধ্যবাধকতা বোধ করেনি, কারণ সরকার বুঝেছে ক্যাম্প সরিয়ে না নিলে জেএসএস আর কোন কিছু করতে পারবে না। এই বাস্তবতা বুঝতে জেএসএস নেতা সন্তু লারমার বেশী দিন লাগেনি। তিনি অস্ত্র জমাদানের কয়েক মাসের পর অভিযোগ করেন, সরকার কেবল জেএসএস-এর অস্ত্রগুলো কেড়ে নেয়ার জন্যই চুক্তি করেছে। তার এই অভিযোগ অবশ্যই সত্য, কিন্তু এই সত্য ও বাস্তবতা তার বোঝা বা উপলব্ধি করা উচিত ছিল চুক্তি স্বাক্ষরের আগে। রাজনীতিতে চোর পালিয়ে যাওয়ার পর মাথায় বুদ্ধি এলে তাতে কোন লাভ হয় না। অথচ সামান্য মনোযোগ দিয়ে চুক্তি পড়লেই যে কেউ বুঝতে সক্ষম হবেন যে, জেএসএস নেতৃত্ব সরকারের উপর অতিমাত্রায় বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করেছিল, বা বলা যায় সরকারকে ব্ল্যাংক চেক দিয়েছিল, যা একজন কুশলী রাজনৈতিক নেতা কখনোই করতে পারেন না। জেএসএস নেতৃত্বের এই যুক্তিহীন অতি আস্থা তাদের রাজনৈতিক আনাড়ীপনা, অপরিপক্ষতা ও অদূরদর্শীতারই পরিচায়ক।

এখানে প্রশ্ন করা যেতে পারে, জেএসএস নেতত্ব এক্ষেত্রে কী করতে পারতেন ? এর উত্তরে বলা যায়, জেএসএস নেতাদের প্রথমেই একটি বিষয় বিচার করা উচিত ছিল – সেটা হচ্ছে তারা যার সাথে চুক্তি করতে যাচ্ছেন তার স্বভাব চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সঠিক ও সম্যক ধারণা গঠন করা। তারা নিশ্চয়ই রুশ বিপ্লবী লেনিনের বই পড়ে থাকবেন (যে কোন সিরিয়াস রাজনৈতিক নেতারই পড়া উচিত)। লেনিন বলেছেন বুর্জোয়া দলগুলো শঠতা, প্রতারণা ও মিথ্যা প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে তাদের শাসন কর্ম চালিয়ে থাকে। আওয়ামী লীগ যে একটি পোড়খাওয়া বুর্জোয়া দল তা জেএসএস নেতারা জানেন না তা কি বিশ্বাস করতে হবে? লেনিন আরো বলেছেন এ দলগুলোর কাছ থেকে অধিকার আদায় ও ভোগ করার জন্য জনগণের সব সময় সজাগ সতর্ক ও আন্দোলন মুখর থাকতে হয় এবং তাদেরকে চাপের মুখে রাখতে হয়।

এ কারণে জেএসএস নেতাদের উচিত ছিল সরকারের চুক্তি মোতাবেক সেনা প্রত্যাহারসহ অন্যান্য বিষয়গুলো বাস্তবায়নের সাথে তাল রেখে অস্ত্র সমর্পন করা। অর্থাৎ চুক্তি এভাবে করা উচিত ছিল যে, জেএসএস-এর ২,০০০ সদস্যের মধ্যে প্রথম দফায় ৫০০ জন অস্ত্র জমা দেবে; এরপর ১৫ দিনের মধ্যে সরকার ৫০০ অস্থায়ী ক্যাম্পের মধ্যে ১৫০ টি ক্যাম্প তুলে নেবে। তারপর জেএসএস দ্বিতীয় দফায় আরো ৫০০ জন সদস্যের অস্ত্র জমা দেবে এবং সরকার আরো ১৫০ টি ক্যাম্প সরিয়ে নেবে। এভাবে যদি দফা ভিত্তিক ও সরকারের সাথে তাল রেখে অস্ত্র সমর্পন করতো তাহলে আর জেএসএস নেতৃত্বকে পরে অনুশোচনা ও বিলাপ করতে হতো না।

কেউ প্রশ্ন করতে পারেন এটা কি সম্ভব ছিল? এই প্রশ্নটি উদয় হওয়ার কারণ হলো চুক্তিতে সরকার হলো শক্তিশালী পক্ষ আর জেএসএস হলো দুর্বল পক্ষ। জেএসএস দুর্বল পক্ষ তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু একমাত্র এই কারণেই জেএসএস নেতৃত্বের আরো বেশী সতর্ক, আরো বেশী দক্ষ ও কৌশলী হওয়া উচিত ছিল। লেনিনের কথা মত জেএসএস-এর উচিত ছিল চুক্তির আগে সংলাপ চলার সময় সরকারকে চাপের মধ্যে রাখা। এই চাপ সৃষ্টি করা যেতো জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে, দেশের প্রগতিশীল অংশকে সাথে নিয়ে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে লবি করে। কিন্তু জেএসএস নেতৃত্ব সরকারকে ছাড়া আর কাউকে আস্থায় নেয়নি। উপরন্তু যেখানে জুম্ম জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করা উচিত ছিল, সেখানে জেএসএস জুম্মদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে, তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন পিসিপি, পিজিপি ও এইচডব্লিউএফএর মধ্যে ভাঙন ধরিয়ে দেয় এবং যারা বাইরে এত বছর ধরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাদেরকে দূরে সরিয়ে দেয়। সরকার সংলাপ ও চুক্তির সময় ও পরে জেএসএস ও জুম্মদের মধ্যেকার এই দুর্বলতার পূর্ণ সুযোগ নেয়।

অস্ত্র সমর্পন বিষয়ে বৃটিশ সরকার ও উত্তর আয়ার ল্যান্ডের মধ্যে সম্পাদিত গুড ফ্রাইডে এগ্রিমেন্ট বা বেলকাস্ট এগ্রিমেন্ট-এর সাথে পার্বত্য চুক্তির তুলনা করা যেতে পারে। বেলকাস্ট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের চার মাস পর - ১৯৯৮ সালের ১০ এপ্রিল। চুক্তিতে আইরিশদের দল সিন ফেইন (Sinn Fein) ‘অস্ত্র সমর্পন’ শব্দগুলো পর্যন্ত লেখতে দেয়নি, তার বদলে লেখতে হয়েছে ‘decommissioning’. তাছাড়া চুক্তিটি উত্তর ও দক্ষিণ আয়ারল্যান্ডে গণভোটে পাশ হওয়ার দুই বছরের মধ্যে ‘decommissioning’ শেষ করার কথা বলা হলেও IRA (Irish Republican Army, সিন ফেইন -এর সশস্ত্র সংগঠন) তাড়াহুড়ো করে তাদের অস্ত্র ধ্বংস করে ফেলার মতো ভুল করেনি। (তারা কোন অস্ত্র সরকারের কাছে জমা দেয়নি)। অপরদিকে জেএসএস অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে চুক্তিতে উপনীত হয় ও তার সকল অস্ত্রভান্ডার সরকারের কাছে জমা দেয়।

২) পার্বত্য চুক্তির অন্য একটি প্রধান দুর্বলতা হলো এর বাস্তবায়নের জন্য in-built mechanism বা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা না থাকা। সত্যি, চুক্তিতে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি বাস্তবায়ন কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই কমিটি নিরপেক্ষ নয়। চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষগুলোকেই কেবল এই কমিটিতে রাখা হয়েছে। যদি কমিটিতে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের রাখা হতো তাহলে বর্তমানে চুক্তির কত শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে বা কত শতাংশ বাস্তবায়ন হয়নি সে নিয়ে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ শুনতে হতো না ।

খ। মৌলিক দাবি পূরণ না হওয়ার দুর্বলতা
চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মৌলিক দাবির কোনটিই পূরণ হয়নি। এই মৌলিক দাবিগুলো হলো স্বায়ত্তশাসন, সেনাবাহিনী প্রত্যাহার, সেটলার প্রত্যাহার, ভূমি অধিকার ও জাতিসত্তার স্বীকৃতি। চুক্তিতে এ বিষয়ে কি উল্লেখ করা হয়েছে যে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।

১) স্বায়ত্তশাসন : জেএসএস-এর দাবি ছিল আইন পরিষদ সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। প্রধানত এই দাবিতেই দীর্ঘ ২২ বছর ধরে সশস্ত্র সংগ্রাম চালানো হয়েছিল। কিন্তু চুক্তির ৭২ টি ধারার কোথাও ‘স্বায়ত্তশাসন’ শব্দটি লেখা নেই। কিংবা অন্য নামে স্বায়ত্তশাসন বা স্বশাসনের ক্ষমতা প্রদানেরও কথা নেই। আমরা জানি রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন বলতে বোঝায় একটি দেশের অভ্যন্তরে কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে স্থানীয় ক্ষেত্রে নির্বাহী, আইন প্রণয়নী ও বিচারিক, আর্থিক ও পুলিশী ক্ষমতার প্রয়োগ। স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্রে এই ক্ষমতাগুলো হলো নূন্যতম। তবে বিশ্বের কোন কোন দেশে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলকে নিজস্ব মুদ্রা চালু ও বিদেশের সাথে চুক্তি করার অধিকার পর্যন্ত দেয়া হয়েছে।

পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে আঞ্চলিক পরিষদ কিংবা জেলা পরিষদকে কোন নির্বাহী ক্ষমতা দেয়া হয়নি। এই পরিষদগুলোর ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। বলা যায় এগুলো উন্নয়নমূলক সংস্থা ছাড়া কিছুই নয়। তিন জেলার নির্বাহী ক্ষমতা রয়েছে জেলা প্রশাসকের হাতে।

স্থানীয় বিষয়ে আইন প্রণয়ণের ক্ষমতাও আঞ্চলিক কিংবা জেলা পরিষদের নেই। বিচারিক ক্ষমতা সীমিত। পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্য ও দায়িত্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো ‘উপজাতীয় আইন ও সামাজিক বিচার’। অর্থাৎ জেলা পরিষদের কেবল ‘উপজাতীয় আইন’-এর ভিত্তিতে ‘সামাজিক বিচার’ নিষ্পন্ন করার ক্ষমতা রয়েছে।

পুলিশী ক্ষমতা সম্পর্কে বলা যায়, চুক্তি মোতাবেক জেলা পরিষদ থানার এসআই ও তার নীচের পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলী ও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। আগে এই ক্ষমতা ছিল এএসআই পর্যন্ত। মোট কথা, পুলিশী ক্ষমতা জেলা পরিষদের নেই। কোন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়োগ ও বদলী করার ক্ষমতা পুলিশী ক্ষমতা বোঝায় না। পুলিশী ক্ষমতা হলো আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশকে ব্যবহার ও পরিচালনা। এই ক্ষমতা জেলা পরিষদ কিংবা আঞ্চলিক পরিষদের নেই, আছে জেলা প্রশাসকের হাতে। অথচ বৃটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় পুলিশ বাহিনী ছিল।

তবে জেলা পরিষদকে নির্দিষ্ট কিছু উৎস থেকে অর্থ উত্তোলনের ও নিজস্ব বাজেট প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

২) সেনা প্রত্যাহার : পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার একটি মৌলিক দাবি। সশস্ত্র সংগ্রাম না থাকলে এবং জেএসএস তাদের অস্ত্র জমা দেয়ার পর সেখানে সেনাবাহিনী থাকার কোন যুক্তি থাকতে পারে না। কিন্তু পূর্বেই বলা হয়েছে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের কোন সময়সীমার উল্লেখ চুক্তিতে নেই। এই না থাকার কারণে সরকার সেনা প্রত্যাহার করছে না। এটা চুক্তির বড় ধরনের দুর্বলতা।

৩) সেটলার প্রত্যাহার : সেটলারদের ব্যাপারেও চুক্তিতে একটি শব্দ পর্যন্ত লেখা নেই। জেএসএস নেতৃত্বের দাবি সেটলারদের সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মৌখিক চুক্তি হয়েছে। কিন্তু সরকার পক্ষ তা অস্বীকার করে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে কোন মতলববাজী বা দুরভিসন্ধি না থাকলে মৌখিক চুক্তি কেন? হতে পারে সেটলার ইস্যুটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। কিন্তু শুধু কি সেটলার ইস্যুটি স্পর্শকাতর বিষয়? সেনাবাহিনী, ভূমি ইত্যাদি বিষয়গুলোও কি স্পর্শকাতর নয়? আর স্পর্শকাতর হলেই কি সে বিষয়ে লিখিত চুক্তি করা যাবে না? এটা কোন ধরনের আহাম্মকি যুক্তি? স্পর্শকাতর ও জটিল বিষয় ফয়সালা করার জন্যই তো আলোচনা ও চুক্তি করা হয়ে থাকে।

চুক্তিতে কেবল সেটলারদের প্রত্যাহারের কথা লেখা নেই তা নয়, তাদেরকে প্রকারান্তরে বৈধতা দেয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন ‘জীবন আমাদের নয়’ রিপোর্টের চতুর্থ আপডেটে বলেছে:

‘তিন নির্বাচিত জেলা পরিষদের ফলে ১৯৭৮ সাল থেকে গোপন সরকারী স্থানান্তর কর্মসূচীর অধীনে নিয়ে আসা ৪,০০,০০০ বাঙালী বসতিস্থাপনকারীদের বেআইনী বসতিস্থানকে বৈধ করা হয়েছে, কারণ বসতিস্থাপনকারীরা ভোট দেয়ার অধিকার পেয়েছে। সর্বোপরি বসতিস্থাপনকারীরা আঞ্চলিক পরিষদের ২২টি আসনের ৭টি এবং জেলা পরিষদের ৩১টি আসনের ৯টি পাবে। অন্য কথায়, চুক্তির ফলে বসতিস্থাপনকারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অন্যদিকে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের স্বীকৃতি পর্যন্ত মেলেনি।’

এক কথায় বলা যায় চুক্তির মাধ্যমে বাঙালিরা আঞ্চলিক পরিষদে ৩২% শতাংশ ও জেলা পরিষদে ২৯ শতাংশ আসন পেয়েছে। যদি পরিষদগুলোর আসন বন্টন করা হয়ে থাকে জনসংখ্যার অনুপাতে তাহলে বাঙালি স্থায়ী বাসিন্দারা এতগুলো আসন পাবার কথা নয়। এতে বোঝা যায় এই আসন বরাদ্দের ক্ষেত্রে বসতিস্থাপনকারী বাঙালিদের উপস্থিতিকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে ।

সেটলারদের বিষয়ে কেন মৌখিক চুক্তি করা হয়েছে তার কোন ব্যাখ্যা জেএসএস নেতৃত্ব আজ পর্যন্ত দেয়নি। অথচ সেনা কর্তৃপক্ষ ও সরকার ব্যক্তি পর্যায়ের আলোচনায় স্বীকার করে থাকে যে, সেটলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসা একটি মারাত্মক ভুল। অনেক উদারনৈতিক ও প্রগতিশীল বাঙালি তাদেরকে সমতলে পুনর্বাসনের পক্ষপাতী। ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ১৯৯৬ সাল থেকে বার বার সমতলে বাঙালিদের পুনর্বাসনের কর্মসুচীতে আর্থিক সহায়তা প্রদানের ইচ্ছা ব্যক্ত করে আসছে। ১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর ইউরোপিয়ান সংসদে গৃহীত প্রস্তাবে এটি আবার সমর্থন ও অনুমোদন করা হয় এবং এতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রস্তাব গ্রহণ করতে বাংলাদেশকে জোর তাগিদ দেয়া হয়।’ [জীবন আমাদের নয়, চতুর্থ আপডেট]

চুক্তিতে সেটলার ইস্যুটি সমাধানের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা মারাত্মক নেতিবাচক ফলাফলের জন্ম দিয়েছে। চুক্তির পর জুম্মদের মধ্যেকার ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের সুযোগ নিয়ে বহু নতুন সেটলার পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢুকে পড়েছে এবং যেখানে ১৯৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি শহরে বাঙালিরা ছিল সংখ্যালঘু, বর্তমানে সেখানে বাঙালি-পাহাড়ির অনুপাত ৩:১। এই অবস্থার জন্য যে জেএসএস নেতৃত্ব দায়ী সে ব্যাপারে কারো ভিন্নমত থাকতে পারে না ।

৪) ভূমি অধিকার: চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রথাগত ভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও তার ভবিষ্যত আইনের স্বীকৃতি মেলেনি। এতে একটি ভূমি কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু চুক্তির দুর্বলতার কারণে এই ভূমি কমিশন আইন পেতে ৪ বছর লেগেছে এবং তারপরও তা ছিল অগণতান্ত্রিক ও চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক। আর এই বিতর্কিত আইন সংশোধন করতে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো ১৫ বছর। যদি জেএসএস-এর অস্ত্র জমাদান সম্পূর্ণ করার আগে ভূমি কমিশন আইন প্রণয়ন ও গঠনের বিধান চুক্তিতে রাখা হতো তাহলে এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না ।

দ্বিতীয়ত : চুক্তিতে লেখা আছে, ‘ভূমি কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি করিবেন।’ কিন্তু এই ‘প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি’র কোন সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। ফলে বিরোধ নিষ্পত্তির সময় জটিলতা সৃষ্টি হতে বাধ্য। তৃতীয়ত, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যা একটি পুরোদস্তুর রাজনৈতিক সমস্যা। চুক্তিতে এই রাজনৈতিক সমস্যাকে আইনী কাঠামোর মধ্যে ফেলে সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে, যা কখনোই সফল হবে না ।

৫) জাতিসত্তার স্বীকৃতি: চুক্তিতে পাহাড়ি বা জুম্ম জনগণের জাতিসত্তার স্বীকৃতি প্রদানের দাবি মেনে নেয়া হয়নি। উপরন্তু তাদেরকে ‘উপজাতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং জেএসএস তা মেনে নিয়েছে। চুক্তির ১ম ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “উভয়পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করিয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছেন।” চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ১ ধারায় আবার উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পরিষদের আইনে বিভিন্ন ধারায় ব্যবহৃত “উপজাতি” শব্দটি বলবৎ থাকিবে।’

অথচ এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর পরই জেএসএস নেতৃত্ব ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতির দাবি তোলে এবং তখন আওয়ামী লীগও প্রথমদিকে পাহাড়িদের আদিবাসী হিসেবে উল্লেখ করেছিল। অর্থাৎ ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষ ছিল সমান আন্তরিক। কিন্তু তারপরও কেন জেএসএস চুক্তিতে ‘আদিবাসী’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করেনি এবং চুক্তির পর আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতির দাবি তুলছে, তার কোন ব্যাখ্যা জেএসএস নেতৃত্ব দেয়নি। কাজেই আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ার জন্য কেউ জেএসএস নেতৃত্ব ও চুক্তিকে দায়ি করলে তাকে কোনভাবে দোষ দেয়া যাবে না । জেএসএস নেতৃত্বের এই রকম বহু ভুলের মাশুল জনগণকে বার বার দিতে হয়েছে এবং এখনো দিতে হচ্ছে।

তবে এক্ষেত্রে এটাও বলে রাখা দরকার যে, চুক্তিতে ‘আদিবাসী’ শব্দটি উল্লেখ করলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো, আদিবাসী বিষয়ক আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্রের সকল অধিকার জনগণ পেয়ে যাবে, তা আমরা আশা করতে পারি না। অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা আছে যে, সরকার আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেই তৎক্ষণাৎ সকল অধিকার লাভ হবে। বাংলাদেশ International Covenant on Civil and Political Rights--এর স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। এই দলিলে বলা আছে: ‘All peoples have the right of self-determination. By virtue of that right they freely determine their political status and freely pursue their economic, social and cultural developmant’ সরকার কি জুম্ম জনগণের অধিকার দেয়ার ক্ষেত্রে এই দলিল মেনে চলছে? মূল কথা হলো অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দলিল মুখ্য বিষয় নয়, মুখ্য বিষয় হলো জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। কিন্তু জেএসএস নেতৃত্ব আদিবাসী স্বীকৃতির দাবিকে প্রধান করে তুলে জনগণকে নিজ অধিকার অর্জনের জন্য আন্দোলনের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক দলিলের মুখাপেক্ষী করে তুলছে, যা অত্যন্ত ভুল ও বিপজ্জনক ।

গ। অন্যান্য দুর্বলতা :
১) চুক্তিতে আঞ্চলিক পরিষদকে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে পরিচালিত সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড সমন্বয় সাধন করার ক্ষমতা দেয়া হলেও আঞ্চলিক পরিষদ কার্যত একটি ঢাল তলোয়ার বিহীন সংস্থা ছাড়া আর কিছুই নয় । সন্তু লারমা এ কথা স্বীকার করে একবার বলেছিলেন, (যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়) পার্বত্য চট্টগ্রামে একজন সাধারণ পুলিশ সদস্যের যে ক্ষমতা আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েও তার সেই ক্ষমতা নেই। আসল কথা হলো, জেলা পরিষদসমূহের ওপর আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ছাড়া আঞ্চলিক পরিষদকে সমন্বয় করার দায়িত্ব প্রদান অর্থহীন। কারণ অর্থ বরাদ্দের জন্য জেলা পরিষদসমূহ আঞ্চলিক পরিষদের উপর নির্ভরশীল ও মুখাপেক্ষী নয়। জেলা পরিষদে সরকারের অর্থ বরাদ্দ আঞ্চলিক পরিষদের মাধ্যমে না গিয়ে সরাসরি চলে যায়। ফলে জেলা পরিষদগুলো যে কোন কাজে আঞ্চলিক পরিষদকে পাশ কাটাতে পারে এবং কোন কাজের জন্য আঞ্চলিক পরিষদের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হয় না। অথচ যদি আঞ্চলিক পরিষদের মাধ্যমে জেলা পরিষদের সরকারী অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হতো তাহলে এ অবস্থা হতো না। জেলা পরিষদকে তখন অবশ্যই আঞ্চলিক পরিষদের সমন্বয় মেনে নিতে হতো ।

২) আঞ্চলিক পরিষদে সংখ্যালঘুতর জাতি যেমন লুসাই, বম, পাংখো, খুমী, চাক ও খিয়াংদের জন্য মাত্র একটি এবং মৃরং ও তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্য একটি আসন বরাদ্দ করা হয়েছে। এটা তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। এই আসন ছাড়াও তাদের জন্য কমপক্ষে ৩টি আসন সংরক্ষণ করা উচিত ছিল, যেভাবে নারীদের জন্য তিনটি সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

৩)  পার্বত্য চট্টগ্রামে যে অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে সে বিষয়ে চুক্তিটি একেবারে নিরব। পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন তার পূর্বোক্ত রিপোর্ট বলেছে : ‘চুক্তিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিচ্যুতি হলো এই যে, এতে (ক) অতীতে সংঘটিত গণহত্যা ও অন্যান্য মানবাধিকার লংঘনের যথাযথ তদন্ত (খ) ঘটনা সংঘটনকারীদের বিচার ও শাস্তি এবং (গ) এইসব মানবাধিকার লংঘনের ফলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। কতিপয় গণহত্যা, মানবাধিকার লংঘন, গুম ও অত্যাচারের ওপর সরকারী তদন্ত রিপোর্ট যেমন ১৯৯৩ সালের নানিয়াচর গণহত্যার সরকারী তদন্ত রিপোর্ট এবং হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কর্মী কল্পনা চাকমার ১৯৯৬ সালের জুন মাসে অপহরণ সম্পর্কে রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশের কোন বিধানও এতে রাখা যায়নি। ভবিষ্যতে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার তদারকি অথবা মানবাধিকার হরণের জন্য জবাবদিহিতার বিধানও এতে নেই। ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা ও সমঝোতার লক্ষ্যে এই সকল পদক্ষেপের অনুপস্থিতিতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সামরিকায়িত থাকা পর্যন্ত, ঐ এলাকায় প্রকৃত শান্তির কোন নিশ্চয়তা নেই। ফলে মানবাধিকার লংঘনের সম্ভাবনা থেকে যাবে এবং জনগণ অনুভব করবে যে তাদের জীবন নিরাপদ নয়।’

আয়ারল্যান্ডে বেলফাস্ট চুক্তিতে দেখা যায় সেখানে সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের অধিকার, মর্যাদা ও সাহায্যের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। এ জন্য নদার্ন আয়ারল্যান্ড ভিকটিম কমিশন গঠন করা হয়েছে। তাছাড়া মানবাধিকার বিষয়গুলো দেখার জন্য একটি New Northern Ireland Human Rights Commission গঠনের কথা বলা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে এ ধরনের কিছু থাকতে পারতো।

৪) পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম চলাকালে হাজার হাজার পাহাড়ি নিজ বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত হয়ে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। তাদের বিষয়ে চুক্তিতে মাত্র একটি লাইন বরাদ্দ রয়েছে: ‘তিন পার্বত্য জেলার অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের নির্দিষ্টকরণ করিয়া একটি টাস্ক ফোর্সের মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’ কিন্তু অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু বলতে কাদের বোঝানো হবে সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন কিছু চুক্তিতে লেখা হয়নি। চুক্তির এই দুর্বলতার কারণেই সরকার বহিরাগত বাঙালি সেটলারদেরকেও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।

৫) চুক্তিতে জেএসএস সদস্যদের সকল মামলা প্রত্যাহার করার কথা বলা হলেও, সে সময় প্রকাশ্যে আন্দোলনরত তিন সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণ পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা সম্পর্কে কোন কিছু উল্লেখ করা হয়নি। জেএসএস নেতৃত্বের সংকীর্ণ মানসিকতা যে এর জন্য দায়ি তা বুঝতে কারোর অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এখানে উল্লেখ করা দরকার, ঐ তিন সংগঠনের বহু নেতাকর্মী জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে জেএসএস-এর অনেক কাজ করে দিয়েছিলেন।

চুক্তির ভবিষ্যত
পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন এখন সরকারের মর্জি বা ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। দীর্ঘ ২৫ বছরে সরকার চুক্তিটি বাস্তবায়নে কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়নি, ভবিষ্যতে নেবে তারও লক্ষণ দেখা যায় না। জেএসএস নেতৃত্বের ভূলের কারণেই এমনটি হয়েছে। তারা যদি সরকারের উপর অন্ধভাবে আস্থা না রাখতেন এবং চুক্তিতে সরকার পক্ষের হাতে ব্ল্যাংক চেক তুলে না দিতেন তাহলে চুক্তিটির আজকের দশা ও পরিণতি হতো না ।

অপরদিকে চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তোলার শক্তি, সামর্থ্য ও ইচ্ছা জেএসএস এর দুই গ্রুপের কোনটির মধ্যে দেখা যায় না। তারা তাদের পূর্বের সংগ্রামী চেতনা ও ইমেজ সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছেন এবং নানাভাবে সরকারের সাথে সম্পর্কিত হয়ে ও বহুক্ষেত্রে সরকারের আনুকূল্যে তাদের নিজেদের সংগঠনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন । আঞ্চলিক পরিষদের গদি-ক্ষমতাসহ সরকারের দেয়া সুযোগ সুবিধা হারানোর ভয় হলো তাদের আন্দোলনে না যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ। অথচ চুক্তি বাস্তবায়ন কেন, ছোটখাট দাবি দাওয়া আদায়ও এদেশে আন্দোলন ছাড়া হয় না। এ অবস্থায় ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির ভবিষ্যত কী হবে তা কি ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়নি?

[লেখাটি উসান মারমা ও নিরুত্তর চাকমার ২০১৭ সালে লেখা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও তার ভবিষ্যত’ শিরোনামের পুস্তিকা থেকে সংগৃহিত ও সংশোধিত]

Post a Comment

Previous Post Next Post