প্রধানমন্ত্রীর খাগড়াছড়ি আগমনে নিরাপত্তার উছিলায় পিসিপি’র পূর্ব নির্ধারিত কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলন করতে না দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি বিবৃতি

প্রতিবাদী ছাত্র সমাজের সাহসী ঠিকানা বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) গভীর দুঃখ ও বেদনার সাথে লক্ষ্য করছে যে, খাগড়াছড়িতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমনকে কেন্দ্র করে প্রস্তুতি ও নিরাপত্তার উছিলায় আমাদের সংগঠনের দেয়াল লিখন মুছে দেয়া হচ্ছে। পিসিপি'র পূর্ব নির্ধারিত কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলন পর্যন্ত করতে দিচ্ছে না, ২৩-২৪ অক্টোবর তা অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল। সাংগঠনিক প্রস্তুতি সুসম্পন্ন করার লক্ষ্যে উক্ত সম্মেলনের তারিখ চূড়ান্ত হয় ৯-১০ নভেম্বর (প্রধানমন্ত্রীর সফরের বিষয়ে পিসিপি অবহিত ছিল না, এ সফরের সাথে সম্মেলনের কোন সম্পর্কও নেই), জেলা প্রশাসন-পুলিশ সুপার ও থানা কর্তৃপক্ষ যথারীতি সে ব্যাপারে অফিশিয়ালি অবহিত এবং প্রশাসন থেকে সম্মতিও প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশের কথা বলে জেলা প্রশাসক-পুলিশ সুপার পিসিপি'র প্রতিনিধি সম্মেলন না করতে সরাসরি মৌখিক নির্দেশ দেন, যা গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী আরও স্পষ্ট ভাষায় বললে সংবিধান স্বীকৃত শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের অধিকার খর্ব করার সামিল। কোন অধিকার সচেতন নাগরিকের নিকট তা গ্রহণযোগ্য হবে না, পিসিপি'র মত একটি লড়াকু সংগঠনের তা মেনে নেয়ার তো প্রশ্নই উঠে না।

পিসিপি দেশীয় পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে এটাও লক্ষ্যে করছে যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষ। সাম্প্রতিক কালে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা গো-হারা হেরেছেন। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-স্বেচ্ছাচারিতায় বিক্ষুব্ধ জনতা আওয়ামী লীগকে ভোটের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করেছে। ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে ধরতে হাসিনা সরকার মরিয়া, ফ্যাসিবাদী নখদন্ত বের করে আবির্ভূত হয়েছে স্বমূর্তিতে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বৈরাচারি কায়দায় সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করছে, আর তা প্রতিবাদী জনতা অমান্য করে সংবিধান স্বীকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করছে। এটাই স্বাভাবিক।

ছাত্র সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন হিসেবে পিসিপি একটি গুরুতর বিষয় কখনও ভুলে থাকতে পারে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষা-ভাষী জাতিসমূহের মত সমতল অঞ্চলের গারো-মুনিপুরী-রাখাইন-সান্তাল-হাজং-ওরাঁওসহ বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিসত্তা ও সম্প্রদায়ের প্রবল আপত্তি ও বিরোধিতার মুখে শেখ হাসিনার সরকার বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাস করিয়ে “বাঙালি জাতীয়তা" চাপিয়ে দিয়েছে। কোন জাতির জাতীয়তা কেড়ে নেয়ার অধিকার কোন সরকারেরই নেই, সে সরকার যত শক্তিশালী বা ÿমতাধরই হোক, পৃথিবীতে সে ধরনের নজীর নেই। অথচ শেখ হাসিনার সরকার সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ভিন্ন ভাষা-ভাষী জাতিসমূহের জাতীয়তা অস্বীকার করে "বাঙালি জাতীয়তা” নির্ধারণ করেছে। ইউপিডিএফ ও ইউপিডিএফভুক্ত সংগঠন পিসিপিসহ কোন গণতান্ত্রিক সংগঠনই আওয়ামী লীগ সরকারের এ অন্যায় ও অযৌক্তিক আইন মেনে নেয় নি এবং কখনও মেনে নেবে না। তদানিন্ত্মন পূর্ব বাংলার জনগণ রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে উর্দু মেনে নিতে পারে নি, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হুমকি তোয়াক্কা না করে বাংলার দামাল ছেলেরা রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিল। আর চাকমা-মারমা-ত্রিপুরাসহ অন্যান্য জাতিসত্তাসমূহ কিভাবে নিজেদের জাতীয়তা বিসর্জন দিয়ে অসম্পূর্ণ অযৌক্তিক “বাঙালি জাতীয়তা” গ্রহণ করবে?!!! জাতীয়তা স্বীকৃতি না দেয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহ কখনই আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করবে না। নিজ জাতিসত্তার স্বীকৃতি আদায়ে পিসিপি লড়াই সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে বদ্ধপরিকর।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ভণ্ডামি দো-মুখী নীতি কখনই পিসিপি'র সতর্ক পর্যবেক্ষণী দৃষ্টি এড়াতে পারে না। ‘৭১ সালে যারা জালিম পাকিস্তান সরকার ও হানাদার পাঞ্জাবি সৈন্যদের সাথে যোগসাজশ করে সাধারণ বাঙালি জনগণের ওপর হত্যা-গুম-ধর্ষণ-লুটপাটসহ অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়েছিল, বর্তমানে যুদ্ধাপরাধী মানবতাবিরোধী হিসেবে তাদের বিচার ও ফাঁসির রায় হয়েছে। অথচ পরিহাসের বিষয় এই, ÿমতাসীনদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে পাহাড়ি জনগণের মধ্যকার একশ্রেণীর জনবিচ্ছিন্ন, প্রতিক্রিয়াশীল, ধান্দাবাজ, চরম স্বার্থান্ধ ও ঘৃণ্য ব্যক্তিদের নিজ দলভুক্ত (আওয়ামীলীগ-বিএনপি) করে রাজাকার-আল বদরের মত ঐ গণদুশমনদের পাহাড়ি জনগণের বিরম্নদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উপনিবেশিক কূটকৌশল খাটিয়ে বাঙালি জনগণকে বিভক্ত ও অধিকার বঞ্চিত রেখে নিপীড়ন-নির্যাতন জারি রেখেছিল (চিরদিন তা পারে নি), বাংলাদেশের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীও পাকিস্ত্মানিদের কায়দায় পাহাড়ি জনগণকে বিভক্ত ও অধিকার বঞ্চিত রাখতে নানা কূটকৌশল খাটিয়ে নিপীড়ন নির্যাতন জারি রেখেছে। এ ধরনের ঘৃণ্য উপনিবেশিক কূটকৌশলের কারণে পাহাড়ি জনগণের মধ্য থেকেও দালাল সৃষ্টি হয়েছে, যারা রাজাকার-আল বদরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু অন্যায় জোরজবরদস্তি চালিয়ে পাহাড়ি জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন কখনই দমন করা যাবে না।

দেশীয় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পিসিপি'র নিকট এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন খাগড়াছড়ি সফর এ অঞ্চলের জনগণের স্বার্থে নয়, নিজের প্রয়োজনে গদি রক্ষার্থে তিনি আসছেন। পাহাড়ি জনগণকে “বাঙালি জাতীয়তা”র হাত থেকে মুক্তি দিতে, তাদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে, পাহাড়ি-বাঙালি জনগণের সুদূরপ্রসারি মঙ্গল ও কল্যানের জন্য নয়, ধোঁকা দিয়ে আগামী নির্বাচনে ভোট বাড়াবার উদ্দেশ্যেই খাগড়াছড়িতে প্রধানমন্ত্রীর আগমন, সফরের উদ্দেশ্য বুঝে নিতে যাতে কারোর ভুল না হয়।

পিসিপি স্মরণ না করে পারে না যে, আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ বারে বারে প্রতারিত ও ÿতিগ্রস্ত হয়েছে। পাহাড়ি জনগণের অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে, সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন অংশটিকে আঞ্চলিক পরিষদের গ্যাড়াকলে বেঁধে রেখেছে, জনগণের কথা বলার তিন সংসদ আসনও দখলে নিয়েছে। পাহাড়ি জনগণকে সংগঠনহীন-প্রতিরোধহীন ও বাকরম্নদ্ধ করার সকল ষড়যন্ত্র চক্রান্ত্ম চালিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রম্নতি বাস্তবায়ন করে নি, উল্টো “বাঙালি জাতীয়তা” চাপিয়ে দিয়েছে। ভূমি বেদখল অব্যাহত রয়েছে, ভূমি কমিশন অকার্যকর রেখেছে, সেনা ক্যাম্প নির্মাণ-সম্প্রসারণ অব্যাহত গতিতে চলছে, তাইন্দ্যং-রাঙামাটি শহরে হামলা-ধ্বংসযজ্ঞের হোতারা সরকার-প্রশাসনের ছত্র-ছায়ায় দাপট দেখিয়ে ঘুরছে, আবারও হত্যাকা- ও ভিটেমাটি ছাড়া করার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, এ পরিস্থিতিতে কোন লজ্জায় বা দায়ে পড়ে প্রধানমন্ত্রী খাগড়াছড়ি সফরে আসছেন সেটাই আমাদের প্রশ্ন। আমরা এটা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ বারে বারে প্রতারিত হতে চায় না। যারা আওয়ামীলীগ ভুক্ত হয়ে সরকারের সাথে মিতালী পাতিয়েছে, তারা পাহাড়ি জনগণের দুশমন তথা রাজাকার-আল বদর, সময়ে একদিন তাদেরও গোলাম আজম-মতিউর রহমান নিজামি-সাঈদি ও সাকা চৌধুরীর মত বিচার হবে। কথায় বলে, চোরের দশ দিন গৃহস্থের একদিন। দেশে একদিন ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হলে, সাধারণ জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে, বাঙালি জনগণের মত পাহাড়ি জনগণের জন্যও দিন আসবে।

পিসিপি এটা দৃঢ়তার সাথে মনে করে, বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী আইন বাতিলপূর্বক পাহাড়ি জনগণের স্ব স্ব জাতীয়তা স্বীকৃতি দিয়ে, প্রথাগত ভূমি অধিকার নিশ্চিত, বেদখলকৃত ভূমি ফিরিয়ে দিয়ে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে এবং বহিরাগতদের জীবিকার নিশ্চয়তাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করেই শেখ হাসিনা খাগড়াছড়ি সফরে আসতে পারেন, তখন পিসিপিসহ গণতান্ত্রিক সংগঠনসমূহ তাকে স্বাগত জানাবে ফুল দিয়ে বরণ করবে। টাকা ছিটিয়ে, লাইসেন্স-পারমিট-ঠিকাদারি-চাকরি নানান প্রলোভন দেখিয়ে দালাল জড়ো করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের কথা বলার আসন কেড়ে নেয়ার মতলবে প্রতারণামূলক সফর পিসিপিসহ সকল আন্দোলনরত গণতান্ত্রিক দল ও সংগঠন তা প্রত্যাখ্যান করবে।

সংবিধান স্বীকৃত সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ, সংগঠনের দেয়াল লিখন মুছে ও জনগণের স্বাভাবিক চলাচল জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে গোয়েন্দা নজরদারি ও রাইফেল তাক করে গণজমায়েত ফৌজি শাসকদের কথাই মনে করিযে দেয়, এতে জনসমর্থন আদায় করা যায় না। পিসিপি সরকার-প্রশাসনের স্বৈরাচারি কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা, বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেয়া, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন সংসদ আসন কব্জা করতে আওয়ামী সরকারের ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপ ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপের প্রতিবাদে পিসিপি নিম্নোক্ত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সর্বস্তরের সংগঠন ও ব্যক্তির নিকট উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে,

১০ নভেম্বর খাগড়াছড়ির সকল উপজেলায় বিক্ষোভ প্রদর্শন

১১ নভেম্বর খাগড়াছড়ি পুরো জেলায় সকাল-সন্ধ্যা সড়ক অবরোধ

  • উপরোক্ত কর্মসূচি সফল করতে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বস্তরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনসহ প্রতিবাদী জনতা এগিয়ে আসুন।
  • নিজ নিজ এলাকায় প্রতিবাদী সভা-সমাবেশ সংগঠিত করুন এবং জাতীয় স্বার্থ বিরোধী ১১ নভেম্বরের সরকারি সমাবেশ বয়কট করুন।
  • ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের পতাকাতলে সমবেত হোন!

বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)
কেন্দ্রীয় কমিটি
পিসিপি'র কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত। ৯/১১/২০১৩


Post a Comment

Previous Post Next Post