ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস চেতনার সংগ্রামে পিসিপি

ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস একটি জাতি বিকাশের প্রধান উপাদান। যে জাতির এসবের বিলুপ্তি ঘটেছে সে জাতি পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। এভাবে বহু জাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বাংলা ভাষার আধিপত্যে এবং যথাযথ সংরক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসত্তার অনেক ভাষা ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে, আর কিছু কিছু ভাষা বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস চেতনাকে ধারণ করে সকল জাতিসত্তার মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা সহ ৫টি দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে অনুষ্ঠিত হয়েছে মাতৃভাষায় প্রতীকী ক্লাশ ও ছাত্র সমাবেশ। এতে সহস্রাধিক ছাত্র-ছাত্রী অংশগ্রহণ করেন। এর আগে একই দাবিতে ধারাবাহিকভাবে ১৬ ফেব্রুয়ারী মহালছড়ি, ১৭ ফেব্রুয়ারী গুইমারা, ১৮ ফেব্রুয়ারি দীঘিনালা, পানছড়ি, কুদুকছড়ি, নান্যাচর ও কাউখালীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়েছে।


১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো এদেশের ভাষা আন্দোলনের অবদানের কারণে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর পরবর্তী বছর (২০০০ সাল) ১৯ ফেব্রুয়ারি পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস্ কাউন্সিল, ওঁরাও ছাত্র সংগঠন, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন, সান্তাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন ও ত্রিপুরা স্টুডেন্ট ফোরাম যৌথভাবে ঢাকায় এক ছাত্র সমাবেশের মাধ্যমে সকল জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকারের স্বীকৃতির দাবি জানায়। এরপর থেকেই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে জাতিসত্তাসমূহের নিজ নিজ মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা লাভের অধিকার নিশ্চিত করা সহ শিক্ষা সংক্রান্ত ৫ দফা দাবিতে আন্দোলন পরিচালনা করছে।

পিসিপি'র অন্যান্য দাবিগুলো হচ্ছে-স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে জাতিসত্তার প্রতি অবমাননাকর বক্তব্য বাদ দেয়া, পাহাড়ি জাতিসত্তার বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনী এবং সঠিক সংগ্রামী ইতিহাস স্কুল- কলেজের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা, বাংলাদেশে সকল জাতিসত্তার সংক্ষিপ্ত সঠিক তথ্য সম্বলিত পরিচিতিমূলক রচনা বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভূক্ত করা এবং  পার্বত্য কোটা বাতিল করে পাহাড়ি বিশেষ কোটা চালু করা।

শিক্ষা সংক্রান্ত উপরোক্ত দাবি বাস্তবায়নের জন্য পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ২০০২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে বিক্ষোভ মিছিল, ১১ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপমন্ত্রী মনি স্বপন দেওয়ান ও ১৬ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুকের বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করে।

শিক্ষা সংক্রান্ত দাবির সমর্থনে পিসিপি ২০০৩ সালে জানুয়ারিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করে। একই ববছর ১৯ ফেব্রুয়ারি তকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা ও প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।  এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দাবিনামা বাস্তবায়নের আশ্বাস জানিয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কাছে একটি চিঠি প্রেরণ করা হয়।  একই বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে একযোগে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়।

এসব দাবি পূরণে ২০০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বরে প্রতীকী অনশন, ২০ ফেব্রুয়ারি জাতিসত্তার ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিবাদে দিনের আলোতে প্রদীপ ও মশাল মিছিল এবং ২১ ফেব্রুয়ারি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। একই দিন রাঙামাটির কাউখালী কলেজ মাঠে বিশাল ছাত্র সমাবেশ ও ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে খাগড়াছড়ির গুইমারা স্কুল মাঠে ছাত্র-গণজমায়েত এবং ১৭ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে ছাত্র মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির বিভিন্ন স্থানে ক্লাশ বর্জন কর্মসূচি পালন করা হয়। একই বছর ১৭ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়।

শিক্ষা সংক্রান্ত ৫ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ২০১৩ সালের ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ এবং ২০১৪ সালের ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারী খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের এই সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজন ছাত্র সমাজের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস চেতনা জাগ্রত করা।  ছাত্র সমাজ জেগে উঠলেই সরকার দাবি মানতে বাধ্য হবে। তাই, ছাত্র সমাজকেই মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এবং ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস রক্ষার সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post