জেএসএসের অদূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে আজও পাহাড়ে শান্তি ফিরেনি

 


শান্ত চাকমা
, অর্থ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ





বর্তমান সময়ে পাহাড়ের রাজনীতি নিয়ে কোন কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। কিছু বিষয়ে বললেই একশ্রেণীর মানুষ বলে এরা আবার শুরু করছে। প্রতিহিংসার রাজনীতির চর্চা করছে যেটা চাকমা ভাষায় (তারা তারা গবাগবি)। আবার কোন কিছু না বলে চুপ করে থাকারও অবস্থা নেই। আমার কথাগুলো সহজ ভাষায় বলার চেষ্টা করবো। 

পাহাড়ে রাজনীতির প্রেক্ষাপট আমরা সকলে জানি। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের সবার মাঝে আলোচনা হওয়া দরকার। আমরা জানি ২০২৪ সালে জুলাই গণঅভ্যুত্থান হয়েছে ছাত্র জনতার নেতৃত্বে। এই গণঅভ্যুত্থানের আগে ফ্যাসিস্ট হাসিনারে দোর্দণ্ড প্রতাপে গুটিকয়েক মানুষ এবং প্রগতিশীল সংগঠন ব্যতিত আওয়ামী শাসনের সমালোচনা করতে পারেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামেও ইউপিডিএফ এবং তার সহযোগী সংগঠন ব্যতিত পাহাড়ি জনগণের স্বপক্ষে দাবি করা অন্য সংগঠনগুলোও ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরোধীতা করেনি।

আমরা এখানে জেএসএসের কথা বলতে পারি। পার্বত্য চট্টগ্রামে জেএসএস একটি প্রাচীন সংগঠন। বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এ সংগঠন একটা সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছিল এবং এই আন্দোলনে জেএসএস নেতা-কর্মীদের আত্মবলিদান ও জীবন যৌবন বিসর্জন দিয়ে তারা যে সংগ্রাম করেছেন সেটা অকপটে স্বীকার করতে হবে। বহু নেতা কর্মীর ত্যাগ ও পরিশ্রমের ফলে শত শত তরুণ বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে অধিকারের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ৮০’র পরবর্তী জেএসএস আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ধীরে ধীরে হারিয়ে পেলে। এই জেএসএসই অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত হাত গুটিয়ে বসেছিল। বর্তমান সময়েও জেএসএস একটা পোড় খাওয়া রাজনৈতিক দল দাবি করে ঠিকই কিন্তু কোন সময়ে কি পদক্ষেপ নিতে হবে সেই দুরদৃষ্টি চিম্তা চেতনা বর্তমান জেএসএস নেতৃত্বের অনুপস্থিত। 

অভ্যুত্থানের আগে জেএসএসের ভুমিকা দেখে মনে হয়েছিল যে তারা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন চায় না। হাসিনার সাথে সুর মিলিয়ে তারা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের রাজাকার উপাধিও দিয়েছে (হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের বিবৃতি নিচে সংযুক্ত করা হলো), যা পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলো। কিন্তু অভ্যুত্থানের পরে তাদের সুর পাল্টে গেল। জেএসএস আবার নতুন করে সার্কাস দেখাতে শুরু করলো। ইন্টারেস্টিং ব্যপার হলো জুলাই অভ্যুত্থানের পরে জেএসএস “বিপ্লবী” বনে গিয়ে নতুন করে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলো। মনে হচ্ছে অভ্যুত্থানে তারা সক্রিয় অংশগ্রহন করেছে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছে.......... ইত্যাদি ইত্যাদি। জেএসএস'র ন্যূনতম যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা দরকার সেটাও আসলে তাদের নাই। বলারতো আসলে অনেক কথা থাকলেও বলতে ইচ্ছা করে না। ঐ যে বললে কথা উঠে “ইয়ুনে আরো তারা তারা গবাগবি গত্তন, তারা তারা মত্তন”।

প্রবীন রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে এবং অধিকারের প্রশ্নে জেএসএস এর নেতৃত্বকে যেভাবে কৌশলী ও সংযত হিসেবে নতুন প্রজন্ম আশা করেছিল বাস্তবে তাদের অবস্থান উল্টো দিকে। তারা সমালোচনা মোটেই সহ্য করতে পারে না। সমালোচনাকারীকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। চুক্তির বিভিন্ন দুর্বলতা সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও চুক্তি সমালোচনাকারীদের প্রধান শত্রু ও তাদের নির্মূল করার ঘোষনাও সন্তু লারমা বেশ কয়েকবার দিয়েছেন। পত্রিকায় সাক্ষাতকার দিয়ে ‘হাত-পা ভেঙে দেয়ার, চোখ উপড়ে ফেলার’ মতো হুমকিও তিনি (সন্তু লারমা) দিয়েছিলেন। যার প্রথম বলির শিকার হন পানছড়িতে প্রদীপ লাল ও কুসুমপ্রিয় চাকমা। এ দুই তরুণ উদীয়মান নেতৃত্বকে হত্যার মধ্য দিয়ে তিনি চুক্তির পরবর্তী সংঘাতের জন্ম দিয়েছেন। যা আজও চলমান। যার অন্যতম কারণ হলো সন্তু লারমা আজ পর্যন্ত শত্রু নির্ধারণ করতে পারেননি। নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সামগ্রীক স্বার্থের বিরোধী ছিলেন বলেই তাকে বা তার কাজকর্মে যারা সমালোচনা করেছেন তাদেরকেই শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। খোদ তৎকালীন জেএসএসের সাধারণ সম্পাদক প্রবীন নেতা চন্দ্র শেখর চাকমা, উদীয়মান নেতা সুদীর্ঘ চাকমাসহ অনেক নেতা এই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন।

আরেকটা বিষয় বলি, সেটা হচ্ছে- জেএসএস মুখ দিয়ে যতই হাঁকডাক দিক না কেন তাদের রাজনৈতিক রুচিবোধও খুবই কম। মহান নেতা এমএন লারমার কথা আমরা সবাই স্মরণ করি। তিনি ৭২-এ সংসদে দাঁড়িয়ে জুম্ম জনগণের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছিলেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি যখন শেখ মুজিবের কাছে দাবিনামা পেশ করেন তখন মুজিব কি বলেছিলেন সেটা সকলেরই জানা। তুরি মেরে ১-২-৩-৪ লাখ বাঙালী পাহাড়ে ঢুকিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। খোদ রাঙামাটি সফরকালেও মুজিব পাহাড়িদের বাঙালী হতে বলেছিলেন, সেটা আমরা কেউ ভুলে যাইনি। 

এখন প্রশ্ন হলো, যে মুজিব তথা আওয়ামীলীগ পাহাড়িদের বাঙালি হওয়ার কথা বলেছেন, লক্ষ লক্ষ বাঙালি ঢুকিয়ে পাহাড়িদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন  সেই মুজিবকে নিয়ে জেএসএসের এত দরদ কোথা থেকে আসে?? উষাতন বাবুদেরতো ১৫ আগস্ট আসলেই চোখের পানির বন্যা বয়ে যায় (মাইন কইরেন না নিচে আলো মিছিলের একটা ছবি সংযুক্ত করলাম), অথচ এমএন লারমা যখন হত্যার শিকার হলেন তখন আওয়ামীলীগ কোন শোকবার্তা দেয়নি। শুধু আওয়ামীলীগ কেন খোদ সংসদেও শোকপ্রস্তাব পাঠ করা হয়নি। আর জেএসএস চব্বিশের অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পা চেঁটে এখন সুর পাল্টিয়ে কখন কি বলছে সেটা তাদেরও অজানা!

জেএসএস নেতা উষাতন তালুকদার দেয়া বিবৃতি ও মিছিলের অংশগ্রহণে ছবি#

সবশেষে যেটা বলবো তা হচ্ছে, জেএসএসের আন্দোলন সম্পর্কে কোন দূরদৃষ্টি চিন্তা ভাবনা নেই। বাবুদের আন্দোলন এবং দাবিনামা ডারউইনের বিবর্তনবাদের মতো বিবর্তন হতে হতে সবশেষে মরা চুক্তিতে গিয়ে ঠেকেছে। বিবর্তন বলছি এই কারণে, যতদিন এমএন লারমা জীবিত ছিলেন ততদিন প্রধান দাবি ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, এমএন লারমা শহীদ হওয়ার পরে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং পরে আরো দাবিনামা রফাদফার ঘষা খাইতে খাইতে হয়ে গেলো চুক্তি। আর এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করতেও তাদের বড়ই অনীহা। উল্টো শাসকগোষ্ঠির “ভাগ কর, শাসন কর” তথা “জুম্ম দিয়ে জুম্ম ধ্বংসের” এজেন্ডা বাস্তবায়নে তারা এখন সদা তৎপর। 

তবে তারা একবার অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে বটে, তবে তাও ছিল সহযোগীতামূলক। তাতে দেখা গেছে আন্দোলনের ডাক দেয়ার পর তা ভুলে গিয়ে সন্তু লারমা নিজেই সেনাবাহিনীর ম্যারাথন দৌঁড় প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়েছেন। এমন অসহযোগ আন্দোলন ইতিহাসে বিরল। তাই তাদের এমন আন্দোলন নিয়ে আমার মতো অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে। 

যাক, আমার কথাগুলো অনেকের খারাপ লাগলেও এটাই চরম সত্য যে, জেএসএসের এমন অদূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই আজও পাহাড়ে শান্তি ফিরেনি।

Post a Comment

أحدث أقدم