পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ভূমিকা

সচেতন চাকমা

প্রত্যেক দেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে তরুণ ছাত্র সমাজ এক গুরুত্বপূর্ণ গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে থাকে। সমাজের আলোকপ্রাপ্ত সচেতন সংবেদনশীল সংগঠিত অংশ হিসেবে তাদের এই ভূমিকা ইতিহাস নির্ধারিত। সমাজের অন্যায় অবিচার নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে এবং পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিবাদে ছাত্র সমাজ। চীনের ৪ঠা মে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ইতিহাস বিখ্যাত। থাইল্যান্ড, জাপান, ফ্রান্স, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে সংগঠিত বড় আকারের ছাত্র বিক্ষোভ এখনো যেন সেইদিনের ঘটনা। বার্মা দক্ষিণ কোরিয়ায় এখনো ছাত্র আন্দোলনের জোয়ার থামেনি। বাংলাদেশে ছাত্র সমাজ মহান ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তর-এর গণঅভ্যূত্থান, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র সমাজ পিছিয়ে নেই। জাতিগত শোষণ, বঞ্চনা নির্যাতনের যাঁতাকলের পিষ্ট অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে জুম্ম ছাত্ররা  বরাবরই সামনের কাতারে রয়েছে। ৬০ দশকে কাপ্তাই বাঁধকেমরন ফাঁদহিসাবে আখ্যায়িত করে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ৭০ দশকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টিতে ছাত্র সমাজই নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা পালন করেছে। সত্তর দশকে এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জোয়ারের উপর ভর করে  জনসংহতি সমিতির উত্থান ঘটে এবং দীর্ঘ বাইশ বছর সশস্ত্র সংগ্রামের পর নব্বই দশকের শেষার্ধে এসে জনসংহতি সমিতি তার আন্দোলন সঠিক দিশা হারিয়ে অনিবার্যভাবে আপোষের পাড়ে আছড়ে পড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনে একটি পর্বের সমাপ্তি ঘটায়। সত্তর দশকের আন্দোলনের ঢেউ যখন ক্ষীয়মান তখনই আশির দশকের শেষের দিকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ গঠনের মাধ্যমে আর একবার পার্বত্য চট্টগ্রামে ছাত্র আন্দোলনের প্রবল যুগান্তকারী উত্থান ঘটে। এই সংগঠনের নেতৃত্বে দীর্ঘ এক দশক ধরে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের ফলশ্রুতি পরিণতিতে ১৯৯৮ সালে ২৬ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফ জন্মলাভ করে। জনসংহতি সমিতির বিচ্যুতি আত্মসমর্পনের পর এই পার্টি বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের লড়াই সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সচেষ্ট রয়েছে এবং ইতিমধ্যে জনগণের ব্যাপক অংশের সমর্থন সহানুভূতি লাভ করেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস রচনা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভাগ্য বিড়ম্বিত জুম্ম জনগণের অধিকার তথা স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পর্কে এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে

গঠনের পটভূমি

জনসংহতি সমিতি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর সত্তর দশকের মধ্য ভাগে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ছাত্র আন্দোলনে চরম শূণ্যতা সৃষ্টি হয়। সমিতির নেতৃত্ব সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত জুম্ম ছাত্রসমাজকে প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে সংগঠিত করে ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলা দূরের কথা, এই নেতৃত্ব এমনকি তাদের ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র সমিতির কার্যক্রম কোন না কোন ভাবে চালু রাখতে চরম ভাবে ব্যর্থ হয়। বাইরে প্রকাশ্যে ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলাকে কর্মসূচী হিসাবে না নিয়ে জনসংহতি সমিতির অধ্যয়নরত  ছাত্রদেরকে কেবল মাত্র সশস্ত্র সংগ্রামে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করানোকেই প্রাধান্য দেয়। এর ফলে বাইরে ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠতে যথেষ্ট সময় অপেক্ষা করতে হয়।

ছাত্রদেরকে সংগঠিত করতে জনসংহতি সমিতির কোনরূপ প্রচেষ্টা না থাকলেও ঢাকা, চট্টগ্রাম রাজশাহীসহ বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত জুম্ম ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই সংগঠিত হতে শুরু করে। ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় ভিত্তিক বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় ছাত্র পরিষদ গঠিত হয়। তাছাড়া ১৯৮৩ সালে ঢাকায় ট্রাইবেল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন এর পর হিল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অব রাজশাহী গঠন করা হয়। ১৯৮৯ সালের আগ পর্যন্ত বিশ^বিদ্যালয় ভিত্তিক এই ছাত্র সংগঠনসমূহ স্বতন্ত্র স্বাধীনভাবে কার্যক্রম চালু রাখে, তবে তাদের মধ্যেই কোনটিই পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে তেমন কোন প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয় এবং তাদের কার্যক্রমও ছিল অত্যন্ত সীমিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার সেনাবাহিনীর অব্যহত নির্দয় দমন পীড়নের বিরুদ্ধেও বলিষ্ঠ কোন প্রতিবাদ সে সময় সংগঠিত করা যায় নি। সারা দেশে চলমান সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনকে যুক্ত করার প্রচেষ্টাও ছিল অনুপস্থিত রাজধানী ঢাকা দেশের আন্দোলনের সূতিকাগার হওয়ায় এই ব্যর্থতার দায়ভাগ প্রথমে এসে পড়ে ঢাকা ট্রাইবেল স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ওপর। সারা দেশে এবং বিশেষত ঢাকায় জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সে সময় যে উত্তাল ছাত্র গণআন্দোলন চলছিল তা থেকে এই সংগঠনের নেতৃবৃন্দ নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখেন। এমনকি ১৯৮৬ সালে ঢাকাস্থ জুম্ম লোকজনের সমর্থন সহযোগীতা পাওয়া সত্ত্বেও ঢাকা ট্রাইবেল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন একটি নির্ধারিত প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৮৬ সালে খাগড়াছড়ি এবং ১৯৮৮ সালে সার্বোতলী-খাগড়াছড়িতে যে লোমহর্ষক গণহত্যা সংঘঠিত হয় তার প্রতিবাদেও কোন মিছিল সমাবেশ ঢাকায় কিংবা অন্য কোথাও করা যায়নি। এইসব একের পর এক গণহত্যা সরকারের পোড়া মাটির নীতি নিষ্ঠুর দমন পীড়নের বিরুদ্ধে তরুণ ছাত্র যুব সমাজ প্রতিবাদের ভাষা খুঁজছিল।

এই প্রেক্ষাপটে ১৯৮৯ সালের ৪ঠা মে রাঙ্গামাটি জেলায় লংগুদুতে এক বর্বরতম গণহত্যা সংঘটিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তির জুম্ম ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ  ঢাকায় সমবেত হন এবং একটি বৃহত্তর একক ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম থেকে এই জঘন্যতম গণহত্যার প্রতিবাদ জানানোর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। সেই মোতাবেক ২০ মে ১৯৮৯ সালে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ জন্ম লাভ করে। তার পরদিন অর্থাৎ ২১ মে এই নতুন সংগঠনের ব্যানারে লংগুদু গণহত্যার প্রতিবাদে ঢাকার রাজপথে জুম্ম ছাত্রছাত্রীদের প্রথম শোক মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ গঠনের পর বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক স্বাধীন সংগঠনগুলো এই নতুন সংগঠনের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। শুরু হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নতুন এক অধ্যায়।

সুবিধাবাদী ধারার বিরুদ্ধে লড়াই

শুরু থেকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের মধ্যে প্রধান দুটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। একটি হচ্ছে সুবিধাবাদী আপোষকামী ধারা, যার প্রতিনিধিত্বকারী নেতৃবৃন্দ চেয়েছিলেন তারাখ্যাতিমানছাত্রনেতাও সাজবেন, আবার জেলা পরিষদের দালালদের সাথে সম্পর্ক রেখে সরকারের বিরাগভাজন হবেন না। এরা বক্তব্য বিবৃতিতে একদিকে জেলা পরিষদের মুণ্ডপাত করে ছাড়তেন, আবার অপরদিকে গোপনে জেলা পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতেন তাদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করতেন। শুধু তাই নয়, এই নেতারা সংগঠনের প্রধান পদসমূহে অধিষ্ঠিত থাকার সময় তৎকালীন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে আপ্যায়ন করে নিয়ে আসেন এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নাম ব্যবহার করে তাকে নিয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের সাথে দেখা করেন। ঘটনা সে সময় সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এই ধারার নেতৃবৃন্দ যেহেতু পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে জেলা পরিষদের কতিপয় নেতার পকেট সংগঠন বানাতে ছেয়েছিলেন, সে কারণে তারা চাননি যে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়ুক। সংগঠনটিকে সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে ছড়িয়ে দিতে তারা তীব্র বিরোধীতা করেন। কারণ তখন তাদের পক্ষে এতো বড় একটি সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়তো। সে কারনে তারা দায়িত্বে থাকা কালে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে কোথাও প্রবেশ করতে পারেনি।

এই আপোষকামী ধারার পাশাপাশি অপর একটি ধারা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের মধ্যে সক্রিয় ছিলো। এই ধারাটি হচ্ছে আপোষহীন প্রগতিশীল ধারা। প্রথমদিকে এই ধারাটি যথেষ্ট শক্তিশালী না হলেও পরে কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রধান ধারায় পরিণত হয় এবং ১৯৯১ সালের সম্মেলনে আপোষকামীদেরকে পুরোপুরি হটিয়ে দিতে সক্ষম হয় সে কারণে ১৯৯১ সালে ১৭-১৮ ডিসেম্বর সম্মেলন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ইতিহাসে দিক নির্দেশনাকারী মাইল ফলক হিসাবে চিহ্নিত

পিসিপির বিস্তৃতি  গণতান্ত্রিক সংগ্রাম

প্রথম দিকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত জুম্ম ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠিত করতে সক্ষম হলেও, খোদ পার্বত্য চট্টগ্রামে সংগঠনকে নিয়ে যাওয়ার কোন প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়নি। যদিও ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ শাহীর পতনের পর পার্বত্য চট্টগ্রামেও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম চালানোর মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৯১ সালের সম্মেলনে প্রসিত বিকাশ খীসা সভাপতি নির্বাচন হওয়ার পরই কেবল আন্দোলনের এই  চিত্র পাল্টাতে শুরু করে। পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক আকারে ছাত্র গণআন্দোলনের জন্য অবজেকটিভ শর্ত বিরাজ করলেও, সাবজেকটিভ শর্ত অর্থাৎ সঠিক নেতৃত্ব না আসা পর্যন্ত সেই আন্দোলন দাবানল আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। এর ঠিক বিপরীতে পাহাড়ি ছাত্র পরষিদ, পাহাড়ি গণ পরষিদ হিল উইমন্সে ফেডারেশনের নেতৃত্বের যথেষ্ট শক্তিশালী ছাত্র গণআন্দোলন জারি থাকা সত্ত্বেও এবং দেশে বাঙালি জনগণ এমনকি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের প্রতি সক্রিয় সমর্থন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবার পরও- অর্থাৎ এক কথায় অবজেকটিভ শর্ত বিরাজ করা সত্ত্বেও জনসংহতি সমিতির মধ্যে নেতৃত্বর দুর্বলতার কারণে আন্দোলনকে নতুন উন্নততর স্তরে নিয়ে যাওয়া সম্ভবতো হয়নি, অধিকন্তু জনসংহতি সমিতি তার সমস্ত শক্তি নিয়ে সরকারে কাছে আত্মসমর্পন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে এক বড় ট্রাজেডি। মস্তিষ্ক বিকৃত কোন লোকের শরীরে যতই শক্তি থাকুক না কেন, পেশী তার যতই শক্তিশালী হোক না কেন, সে ব্যক্তির দ্বারা যেমন স্বাভাবিক কাজকর্ম যেমন চাষবাস, লেখা পড়া সম্ভব হয় না এবং ব্যক্তি তার শারীরিক শক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেনা, ঠিক তেমনি জনসংহতি সমিতিও সামগ্রিকভাবে জুম্ম জনগণের অনেক শক্তি থাকা সত্ত্বেও সে শক্তিকে সঠিক উন্নত নেতৃত্বের অভাবে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। জন্য আন্দোলনে সাবজেকটিভ অবজেকটিভ শর্তগুলোর বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুতপূর্ণ।

প্রসিত খীসা কর্তৃক নেতৃত্ব গ্রহণের পর ছাত্র গণআন্দোলন সর্বব্যাপী তীব্র রূপ ধারণ করে। সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ছড়িয়ে পড়ে এবং ছাত্র সাধারণ জনগণ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে সামিল হতে থাকে। যেন পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলনের মরা গাঙে জোয়ার ফিরে আসে। হতাশাকিষ্ট, দিশাহীন দিকভ্রান্ত জুম্ম জনগণ নতুন করে স্বপ্ন ফিরে পায়। প্রতিবাদ বিক্ষোভে সারা পার্বত্য চট্টগ্রাম কেঁপে ওঠে। একই সাথে ঢাকার রাজপথও প্রতিবাদী লড়াকু ছাত্রদের মিছিলের পদভারে প্রকম্পতি হয়। লড়াইয়ের ময়দানে মুখোমুখি হয় পাহাড়ি ছাত্র পরষিদ বনাম সরকার-সেনাবাহিনী। পার্বত্য চট্টগ্রামের একচ্ছত্র অধিপতি যে সেনাবাহিনী গেরিলা হামলায় তেমন কোন ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি সে সেনাবাহিনী পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে ব্যাপক ছাত্র গণআন্দোলনের মুখে পর্যায়ক্রমে পিছু হটতে বাধ্য হয়।

১৯৯২ সালরে ১০ এপ্রলি সংঘটিত হয় লোগাং গণহত্যা। পাহাড়ি ছাত্র পরষিদরে নেতৃত্বে খাগড়াছড়ি শহর প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বৈসাবি আনন্দ উৎসব শোক সাগরে পরিণত হয়। পাহাড়ি ছাত্র  পরিষদের আমন্ত্রণে ঢাকা থেকে আগত রাজনৈতিক দল ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার কর্মি লেখক, সাংবাদিকরাও আনন্দ উৎসবের পরিবর্তে আপামর জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সামিল হন। খাগড়াছড়রি হাজার হাজার আবাল বৃদ্ধ-বণিতা সেদিন বাঁধ ভাঙা পানির মতো রাজপথে নেমে প্রথম সরকারের বর্বরতার প্রতিবাদ জানান। স্বতঃস্ফূর্তভাবে জুম্ম জনগণের ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসব বর্জন করা হয়। শহীদদের সম্মান জানাতে রান্না করা পাজন (মূল উৎসবের দিন হরেক রকমের সবজি দিয়ে তৈরি খাদ্য বিশেষ) চেঙ্গী নদীতে ফেলে দেয়া হয়। হাজার বাতি প্রজ্জ্বলতি হয়। যে জনগণ বছরের পর বছর ধরে সরকার সেনাবাহিনীর বুটের তলায় পিষ্ঠ হয়ে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন, যাদের দিকে সারাক্ষণ তাক করা থাকে মেশিন গানের ব্যারেল, প্রতিনিয়তই যাদেরকে মৃত্যু, গ্রেফতার শারীরিক নির্যাতনের ভয়ে ত্রতস্থ থাকতে হয় সেই চির অবহলেতি হতভাগ্য জনগণ পাহাড়ি ছাত্র পরষিদের নেতৃত্বের যাদুর কাঠির ছোয়ায় জেগে ওঠে এভাবেই সরকারের বর্বর দমন নীতির প্রতিবাদ জানালেন। নতুন প্রজন্মের প্রতিবাদী নির্ভিক নেতৃত্বে তারা আশার আলো খুঁজে পেয়ে নিপীড়ন নির্যাতনের জোয়ালের ভারে ন্যুজ মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ালেন। কিভাবে শাসক শোষক গোষ্ঠির সাথে লড়তে হয় উভয়েই তা হাতে কলমে পরখ করে শিখে নিলেন। ফলে লড়াইয়ের ময়দানে জনগণ নেতৃত্ব একাত্মা হয়ে গেলেন। তারপর শুরু হলো ঐতিহাসিক লোগাং লং মার্চ।

সেদিন ছিল ২৮ এপ্রিল ১৯৯২। পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় একটি দিন। বহু বছরে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ বিক্ষোভ বিষ্ফোরিত হওয়ার দিন। লোগাং গণহত্যার প্রতিবাদ শহীদদের প্রতি সম্মান জানাতে খাগড়াছড়ি শহর থেকেশুরু হয় এই পদযাত্রা। শত শত হাজার হাজার নারী পুরুষ বাড়ী ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এই সংগ্রামী কাফেলায় সামিল হন। ঢাকা থেকে প্রগতিশীল বিপ্লবী রাজনতৈকি দলের নেতা, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মি লেখকরাও পাহাড়ি জনগণের আন্দোলনের সাথে সংহতি জানিয়ে এই পদযাত্রায় অংশ নেন। তাদের এই অংশগ্রহণ জুম্ম জনগণের মনে আরো বেশী শক্তি সাহস সঞ্চার করে। গণহত্যার পর পরই পিসিপি নেতৃবৃন্দও বৈসাবি উৎসবে ঢাকা থেকে আমন্ত্রিত অতিথিরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে চাইলে পানছড়িতে সেনাবাহিনী তাদেরকে আটকিয়েছিল। কিন্তু সেই সেনা সদস্যরা লং মার্চের সময় হাজার হাজার ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদী জনতার গতি রোধ করতে পারেনি। সেদিন জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তির কাছে সেনা শাসকরা পরাজিত হয়। জনগণের দিকে এতদিন ধরে তাক করে রাখা শত শত সেনা জোয়ানের হাতের মেশিনগানের ব্যারেল জনতার অগ্রাভিযানের মুখে নেতিয়ে পড়ে। সূচিত হয় জনতার বিজয়। জনগণ এগিয়ে যেতে থাকেন। আন্দোলনের ধারাবাহকিতায় যোগ হয় আরো বহু বীরত্বপূর্ণ ঘটনা। জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের অন্যতম অস্ত্র ১৪৪ ধারা বার বার লংঘন করে ছাত্র জনতা সাহসের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ফলে অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠির মনোবল চুরমার হয়ে যায়।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, জনসংহতি সমিতি বহু বছর ধরে লড়াই সংগ্রাম পরিচালনা করেছে এবং আন্দোলনে তারা অনেক ইতিবাচক অবদান রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের মধ্যেও অনেক বিভ্রান্তি সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যার কারণে তাদের আদর্শিক বিচ্যুতি ঘটে এবং আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে করুণ রাজনৈতিক অপমৃত্যু অনিবার্য হয়ে ওঠে। জেএসএস নেতৃত্বের অনেক সীমাবদ্ধতার একটি দিক হচ্ছে এই যে, এই নেতৃত্ব বহু বছর ধরে নিয়মতান্ত্রিক অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সংগ্রাম জারি রাখলেও, জনগণের কাছে তাদের দাবি দাওয়া কী তা তারা ব্যাখ্যা করতে পারেনি। ফলে জনগণ জানতো না তাদের দাবি কী, তারা আসলে কী চায় এবং কেন চায়। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদই রাঙামাটিতে ৩য় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে সরাসরি স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে এই দাবিকে ঘরে ঘরে জনপ্রিয় করে তুলে। তার পর থেকেই কেবল জনগণ জানতে পারে তারা কী চায়। জেএসএস অন্য অনেকে বহু আগে এই দাবি উত্থাপন করলেও প্রসিত খীসার নেতৃত্বে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদই গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় তাকে জনগণের প্রাণের দাবি হিসেবে তাদের কাছে নিয়ে যায়। রাঙামাটিতে এই দাবি উত্থাপনের আগে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের দাবি ছিলপার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধান চাই”, যা ছিল শ্লোগান দাবি হিসেবে অস্পষ্ট, দ্ব্যর্থবোধক অনাকর্ষণীয়। তবে সে সময়ের বাস্তবতায় দাবি উত্থাপন ছিল এক ধাপ অগ্রগতি প্রগতিশীল। কিন্তু পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের স্বায়ত্তশাসন দাবি উত্থাপনকে কারোর ব্যক্তিগত খেয়াল উচ্চাভিলাষ বলে যারা সে সময় বিরোধীতা করেছিলেন, তারা যে রাজনীতির --- না বুঝে করেছিলেন তা প্রমাণিত হতে বেশী দিন লাগেনি। বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস এই শিক্ষাই দেয় যে, যে কোন রাজনৈতিক দাবি শ্লোগানকে অবশ্যই স্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট, অদ্ব্যর্থবোধক সংক্ষপ্তি হতে হবে এবং সেই নির্দিষ্ট সময়ে জনগণের অভিব্যক্তিকে সারৎসার হিসেবে তুলে ধরতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক অধিকার সচতেনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ভূমিকা অসামান্য সেনাবাহিনী সরকার জনগণের গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক অধিকার সেখানে বুটের তলায় দাবিয়ে রেখেছিল। কোন প্রকার সভা সমাবেশ সরকারীভাবে নিষিদ্ধ না হলেও প্রবল সামরিকায়নের কারণে তা ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামে এই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়। তবে সহজভাবে এটা হয়নি, এজন্য তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে, জেল জুলুম নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যুক্তি ন্যায়ের কাছে জনগণের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার প্রচেষ্টা পরাজিত হয়। সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সভা সমাবেশে মিছিল হতে থাকে। সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচীও পালিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ তাদের নাগরিক সংবিধান স্বীকৃত অধিকার সম্পর্ক সচেতন হয়।

দালাল বিরোধী অভযিান

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলে সরকার সেনাবাহিনীর দালালসহ সকল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। হিল লিটারেচার ফোরামের অনিয়মিত প্রকাশনা 'রাডার' নিষিদ্ধ হওয়ার পর ফোরামস্যাটেলাইটনামে যে ম্যাগাজিন প্রকাশ করে সেখানে লেখা হয়েছেদালালদেরপ্রতিরোধ করতে কৃষ্ণমা ছড়া এলাকায় জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাজার হাজার ছাত্র জনতার মিছিল সমাবেশ হয়েছে দালালদের বিরুদ্ধে। রাঙ্গামাটি শহরে স্কুলের প্রাণতেজী ছাত্ররা কুখ্যাত দালাল সাধন মানিক কার্বারী (দেরেঙ) কে ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সময় বেশ কয়েক ঘণ্টা নিজ গৃহে অন্তরীণ রাখে। ছাত্ররা সেখানে দালালদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়। পরে তারা উক্ত কুখ্যাত দেরেঙকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতাদের কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করে।

গত ১১ জুলাই ৯২ খাগড়াছড়ির সাহসী জনতা দিঘীনালার কুখ্যাত হেডম্যান দালাল দীপংকর তালুকদারকে সাংঘাতিকভাবে গণপিটুনি দিয়েছে। এই নরপশুটির অপকর্ম সুবিদিত। অনেক নিরীহ লোককেশান্তিবাহিনীবলে ধরিয়ে দিয়ে আবার নিজেই ক্যাম্প থেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য জনগণের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই কুখ্যাত হেডম্যান। অনেকের বিরুদ্ধে সেনা ক্যাম্পে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়েছে সে। তাছাড়া সে সেনাক্যাম্পে যুবতি নারী সরবরাহও করে থাকে নিয়মিতভাবে।........ ১৩ জুলাই ৯২ দিঘীনালার তথাকথিত কমান্ডার দুষ্কৃতকারী খনি রঞ্জন ত্রিপুরাকে খাগড়াছড়ির ছাত্র জনতা অপদস্থ করে। সে জনতার কাছে তার সমস্ত দুষ্কর্মের কথা স্বীকার করেছে। জাতীয় গণস্বার্থ পরিপন্থী কোন অপকর্মে আর লপ্তি হবে না বলে সে জনতার কাছে অঙ্গীকার করে কৃত দুষ্কর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে জনগণ নিজেরাই এভাবে গণস্বার্থ বিনাশকারী প্রতিক্রিয়াশীলদরে প্রতিহত করে। প্রবল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জোয়ারে দালাল স্পাই গোষ্ঠি খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। কাউকে শারীরিকভাবে নির্মূল করতে হয়নি, যেমনটা শান্তিবাহিনী অতীতে করেছিল। জনগণের শত্রুকে জনগণই প্রতিহত করবে এটাই ছিল পিসিপি নীতি। কারণ একমাত্র জনগণের সংগঠিত শক্তিই এদের দমন করতে সক্ষম। এভাবে দালাল স্পাইদের বিরুদ্ধে ছাত্র জনতার গণতান্ত্রিক কর্তৃত্ব প্রয়োগের ফলে জনসংহতি সমিতির পক্ষেও তাদের কার্যক্রম জোরদার করা সহজ হয়ে ওঠে। এদের দাপটের ফলে অনেক এলাকা থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলতে হয়েছিল।

বাঙালীদরে সমর্থন আদায় বহুল প্রচার

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ জুম্ম জনগণের প্রতি দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, লেখক বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়। তারা নিয়মিতভাবে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কর্মসূচীতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিকাশে ভূিমকা রাখেন। ফলে সারাদেশের শোষিত নিপীড়িত গণমানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের লড়াইয়ের সাথে পাহাড়ের আন্দোলনের সেতুবন্ধন ঘটে। বহু সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আন্দোলন সম্পর্কে নানা ধরণের অপপ্রচারণা চালিয়ে দেশের সাধারণ জনগণের মনে যে বিভ্রান্তি সন্দেহ সৃষ্টি করা হয়েছিল, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলে তা বহুলাংশে কেটে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা, সেখানকার জনগণ তাদের আন্দোলন সংগ্রাম সম্পর্কে জানার জন্য সাধারণ বাঙালি জনগণের মধ্যেও ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

সেনাবাহিনী শাসক গোষ্ঠির দমন পীড়ন

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের উত্থান গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে শাসকগোষ্ঠি ভীত হয়ে পড়ে। পরিষদ যাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে বিস্তৃতি ঘটিয়ে অগণিত ছাত্র জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনে গণজোয়ার সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য সরকার সেনাবাহিনী মরিয়া চেষ্টা চালায়। সংগঠনের কার্যক্রম বৃদ্ধির সাথে সাথে সরকারী দমন পীড়ন শুরু হয়ে যায়। ১৯৯২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশাল ছাত্র সমাবেশ সংসদের স্পীকারের কাছে স্মারকলিপি পেশ শেষে ফিরে যাওয়ার সময় তার পরদিন খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে ছয় জন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতাকর্মিকে সেনাবাহিনী ক্যাম্পে আটক করে। পরে তাদেরকে পুলিশের নিকট হস্তান্তর করা হয়। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কোন কর্মসূচীতে অংশ নেয়ার কারণে গ্রেফতারের এটাই প্রথম ঘটনা। এর পর পার্বত্য চট্টগ্রামে গ্রেফতার, ভয়ভীতি প্রদর্শন, সমাবেশ বানচালের ষড়যন্ত্র দাঙ্গা, নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সে সময়ে হিল লিটারেচার ফোরাম কর্তৃক প্রকাশিত সাড়া জাগানো জনপ্রিয় পত্রিকারাডার’-এর ১৩ এপ্রিল ১৯৯২ সংখ্যায় আইন সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে

আইন সালিশী কেন্দ্রসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার আর্থিক সহায়তায় যাবৎ ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক ৪২ জন পাহাড়ির জন্য মহামান্য হাইকোর্টে রীট আবেদন করা হয়েছে।............ পর্যন্ত ২৬ জন বন্দীর আটকাদেশ মহামান্য হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছেন এবং সব কয়জন বন্দীর মুক্তির আদেশ মার্চ মাসের ৩১ তারিখের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক কারা কর্তৃপক্ষের বরাবরে মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃপক্ষ প্রেরণ করেছেন।” 

উক্ত প্রতিবেদনে বন্দীদের নাম অন্যান্য বিবরণও ছাপা হয়েছিল। এরপর রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগেরাডারনিষিদ্ধ হলে প্রথমেস্যাটেলাইট পরে তাও নিষিদ্ধ করা হলে হিল লিটারেচার ফোরামজুষ্মকণ্ঠনামে ম্যাগাজিন প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এটিও প্রথম সংখ্যা বেরুবার পরই সরকার পরবর্তী প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে দেয়। ২০ নভেম্বর ১৯৯২ সালে প্রকাশিতজুষ্মকণ্ঠেজানানো হয় যে পরবর্তীতে আরো যে সব বন্দীর আটকাদেশের বিরুদ্ধে রীট আবেদন দায়ের করা হয়েছে তাদের মধ্যে ২১ জন মুক্তি পেয়েছেন। জুষ্মকণ্ঠের উক্ত প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয় যে, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম তখন ৩৮ জন পাহাড়ি বন্দীর পক্ষে হাইকোর্টে রীট মামলা পরিচালনা করছিলেন। ছাড়াও একই সময়ে এডভোকেট নিজামুল হক নাসিম তার সহযোগী আদিলুর রহমান খান অন্য ২৬ জন বন্দীর পক্ষে রীট পিটিশন পরিচালনা করেন।

রাডার জুমকণ্ঠে প্রকাশিত উক্ত প্রতিবেদন পড়ে একজন গণ্ডমূর্খ বোকারও বুঝতে অসুবিধা হবে না যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং সুনির্দিষ্টভাবে বললে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের অগ্রযাত্রা রোধ করার জন্য ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে পরিষদের নেতাকর্মি সাধারণ সমর্থকদের আটক করা হয়েছিল। তাদের কারোর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ ছিল না। হাইকোর্ট যে এই সমস্ত আটকাদেশ অবৈধ ঘোষণা করে বন্দীদের মুক্তির আদেশ দেয় তাতেও এটাই স্পষ্ট হয় যে, গ্রেফতারের উদ্দেশ্য ছিল সর্বাংশে রাজনৈতিক।

কিন্তু ছাত্র যুবকদের এভাবে গণহারে আটক, গ্রেফতার হয়রানি সত্ত্বেও সরকার পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বিস্তৃতি রোধ করতে সক্ষম হয়নি। বরং ধরনের নির্যাতনমূলক পদক্ষেপ পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের জনপ্রিয়তা আরো বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে সরকার সেনাবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। অপ্রতিরোধ্য পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে মোকাবিলার জন্য আরো বেশী ক্ষিপ্ত বেপরোয়া হয়ে ওঠে। কেবল গ্রেফতার করে যখন আন্দোলন দমন করা যাচ্ছিল না তখনই পার্বত্য গণপরিষদ, কৃষক শ্রমিক বাঙালী কল্যাণ পরিষদ, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ইত্যাদি চরম প্রতিক্রিয়াশীল সেনা মদদপুষ্ঠ সংগঠনের জন্ম দেয়া হয়। সেনাবাহিনী সব সংগঠনকে মাঠে নামিয়ে তাদেরকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। মূলতঃ সেটেলারদের মধ্য থেকে কতিপয় ধান্ধাবাজ সুযোগ সন্ধানী দুর্বৃত্ত এইসব সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সাথে যোগ দেয়। তাদের সাথে সাধারণ বাঙালীদেরও কোন সম্পর্ক ছিল না। তবে সাধারণ সেটেলাররা তাদের জীবন ধারণের জন্য সরকারের খাদ্য রেশনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে সেনাবাহিনী অনেক সময় তাদেরকে উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ যখনই কোন সভা সমাবেশের কর্মসূচী ঘোষণা করে তখনই সব সংগঠনগুলোকে সক্রিয় করা হয়। বর্তমানে পিসিপি কোন সমাবেশ অনুষ্ঠানের ঘোষণা করলেই যেমন তা পণ্ড করে দেয়ার জন্য জেএসএস-এর অনুগত ছাত্ররা একই জায়গায় একই সময়ে সভা আহ্বান করে থাকে, সেনা মদদপুষ্ঠ পার্বত্য গণপরিষদ অন্যান্য সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোও সে সময় তাই করতো। এখানে দুএকটি উদাহরণ অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ১৯৯২ সালের ২০শে মে রাঙ্গামাটি কলেজ প্রাঙ্গণে তৃতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয় বেশ আগে থেকে এবং সে মোতাবেক প্রস্তুতিও চলতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করে ১৯শে মে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নামে তাৎক্ষণিকভাবে গজিয়ে ওঠা একটি ভূঁইফোড় সংগঠন ঘোষণা দেয় যে, তারাও একই সময়ে একই জায়গায় সমাবেশ করবে। ফলে কলেজ কর্তৃপক্ষ অপ্রীতিকর ঘটনার আশংকায় কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে এবং ২৬ তারিখ পর্যন্ত কলেজ চত্বরে সকল প্রকার সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ তাদের সমাবেশস্থল শিল্পকলা একাডেমী প্রাঙ্গণে পরিবর্তন করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিনা কারণে কোন প্রকার উস্কানি ছাড়াই তথাকথিত সর্বদলীয় ছাত্র পরিষদের লোকজন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ্যালিতে হামলা চালায়। রাডার জুন ১৯৯২ সংখ্যায় প্রকাশিতরাঙ্গামাটিতে বর্ণবাদের গন্ধ, সন্ত্রাসের লাগাম কার হাতেশিরোনামের একটি লেখায় হামলা সম্পর্কে উল্লেখ করে বলা হয়,

সকাল টায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের অনুষ্ঠান শুরু হয়। জাতীয় সঙ্গীত দলীয় সঙ্গীতসহ উদ্বোধনের পর সংগঠনের সভাপতি মিঃ প্রসিত বিকাশ খীসার ভাষণ শেষ না হতেই তথাকথিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা পাহাড়ি ছাত্রদের সমাবেশের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। দশ বিশ গজের মধ্যেই ছিল দাঙ্গা পুলিশ। কিন্তুসংগ্রাম পরিষদেরকর্মীদের হামলা চলাকালে দাঙ্গা পুলিশ কোন বাধা দেয়নি। বরং নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙ্গামাটি কলেজ শাখার জি, এস, বোধিসত্ত্ব চাকমা সংগ্রাম পরিষদের কর্মীদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করার আহ্বান জানান। কিন্তু সে কথায় তারা কোন আমল দেয়নি। তারা পাহাড়ি ছাত্রদের লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে। এরপর পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ তাদের আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসে এবং ধাওয়া করে তেড়ে নিলেসংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা রাণী দয়াময়ী স্কুলের সামনে অবস্থান নেয়। সময়ই পুলিশ পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কর্মীদের ওপর লাঠি চার্জ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এতে অনেক পাহাড়ি ছাত্র আহত হয়।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সংগঠিত শক্তি দেখে সংগ্রাম পরিষদেরকর্মীরা আপোষ করতে আসে এবং আর হামলা করবে না বলে অঙ্গীকার করে। কিন্তু পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের র‌্যালী শেষে সবাই যখন ছত্রভঙ্গ হয়, তখনসংগ্রাম পরিষদেরগুণ্ডারা আবার হামলা চালায়। তারা বাড়ি ফিরতি লোকজনের ওপর দা, কুড়াল, খন্তা, বল্লম ইত্যাদি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাহাড়িদের মালিকানাধীন দোকানে লুটপাট ভাঙচুর করে। বনরূপা পেট্রোল পাম্পের পাশে কাটা পাহাড়ে পাহাড়িদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাদের হামলায় ট্রাবেল আদাম, বনরূপা কাটাপাহাড়ে শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়ে যায় এবং কয়েক লক্ষ টাকার মালামাল লুট হয়। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের তৎকালীন অর্থ সম্পাদক দেবাশীষ চাকমাসহ অনেকে গুরুতর আহত হয়।

বান্দরবানেও ১৯৯৫ সালের ১৫ মার্চ একই কায়দায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সমাবেশ বানচাল করে দেয়া হয়। সেখানে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের জেলা শাখার সম্মেলন ১৫ মার্চ করা হবে বলে বহু আগে থেকেই ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু হঠাৎ ১৩ মার্চ কুখ্যাত দালাল সাচিং প্রু জেরীর বাসভবনে মিটিং করে কতিপয় দাগি মাস্তান বিএনপি নেতা কর্মীবান্দরবানের শান্তিপ্রিয় জনগণনামে একটি ভূঁইফোর সংগঠনের জন্ম দেয়। ১৫ মার্চ ১৪৪ ধারা জারি থাকা সত্ত্বেও তারা মিছিল করে পাহাড়ি বিদ্বেষী উস্কানিমূলক শ্লোগান দেয় এবং পুলিশের সহায়তায় মারমা অধ্যুষিক উজানী পাড়া মধ্যম পাড়ায় হামলা চালায়। তারা লুটপাট বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। হামলায় রিক্তন চাকমাসহ পিসিপি জন নেতাকর্মী মারাত্মকভাবে আহত হয়। পুলিশ উল্টো পিসিপি ৩১ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে ২২ জনকে গ্রেফতার করে।

কেবল রাঙ্গামাটি বান্দরবানে নয়, আরো বিভিন্ন জায়গায় সেনাবাহিনী সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভা সমাবেশের ওপর লেলিয়ে দেয়। ১৯৯৩ সালে ১৭ নভেম্বর নানিয়াচরে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপর হামলা চালানো হলে এতে কমপক্ষে ৩৬ জন নিহত হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরাও সেটেলারদের সাথে এই গণহত্যায় অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৯২ সালের ১৩ অক্টোবর দীঘিনালায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ কর্তৃক আহূত সমাবেশে হামলা চালানো হয়। এতে ৭০ বছরের বৃদ্ধ ভরতদাস মুনি নিহত হন। তাছাড়া বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অজুহাত সৃষ্টি করে সেনাবাহিনী দাঙ্গা বাঁধানোর জন্য সব সংগঠনগুলোকে উস্কানি দিয়ে থাকে।

এভাবে বহু ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে। অপরদিকে সেনাবাহিনী পিছু হটে যেতে বাধ্য হয় এবং তাদেরকে অনেক কিছু ছাড় দিতে হয় যা কিছু সময় আগেও ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাহাড়ি জনগণের জেগে ওঠা নতুন শক্তি গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমনের জন্য সেনাবাহিনী প্রশাসন সকল ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে।

মুখোশ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ

এত কিছু করার পরও যখন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণ পরিষদ হিল উইমেন্স ফেডারেশনকে স্তদ্ধ করা গেল না তখন সেনাবাহিনী নতুন এক কৌশল অবলম্বন করে। এবার শুরু হয় পাহাড়িদের মধ্য থেকে দাগি আসামী, মাস্তান সামাজিক বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের অর্থ চাকুরীর লোভ দেখিয়ে জড়ো করে তাদেরকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদসহ তিন সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। উদ্দেশ্যে ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসেপিজিপি-পিসিপি সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটিনামে খাগড়াছড়ি ব্রিগেডে একটি ঠ্যাঙারে বাহিনী গঠন করা হয়, যা সাধারণ লোকজনের কাছে মুখোশ বাহিনী নামে পরিচিত। কারণ এরা প্রথমদিকে মুখোশ পরে সেনা গোয়েন্দা পুলিশের কড়া প্রহরায় খাগড়াছড়িতে মিছিল (?) করতো। মেজর মাহবুব নামে সেনাবাহিনীর একজন কুখ্যাত মেজর- যিনি পরে ঢাকার বাড্ডা এলাকায় ছিনতাই করার সময় হাতে নাতে পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হন- এই মুখোশ বাহিনী গঠনে পরিচালনায় অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেন। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে এই যে, ১৫ই জুন সন্তু লারমা ধুধুকছড়ায় অপেক্ষামান জনতার উদ্দেশ্যেগুলতি মেরে.... স্বায়ত্তশাসন কায়েম করা যায় নাবলে আন্দোলন বিরোধী বক্তব্য দেয়ার পরই সেনাবাহিনী মুখোশ বাহিনী গঠন চুড়ান্ত করে। অনেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশ্লেষক সন্তু লারমার বক্তব্যকে সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে গ্রীন সিগন্যাল বলে অভিহিত করেন, কারণ তার বক্তব্য দেয়ার কয়েক মাস আগে থেকেই ইউপিডিএফ-এর বর্তমান নেতৃত্বের সাথে আন্দোলনের বিভিন্ন কৌশলগত দিক নিয়ে জেএসএস নেতৃত্বের মতদ্বৈততা শুরু হয়েছিল।

অচিরেই এই মুখোশ বাহিনী সেনাবাহিনী প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষত খাগড়াছড়িতে সন্ত্রাস অরাজকতার রাজত্ব কায়েম করে এলাকায় তারা ত্রাস হিসেবে পরিচিত হয়। পাহাড়ি গণপরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ হিল উইমেন্স ফেডারেশনের মুখপত্র (বর্তমানে ইউপিডিএফ-এর) স্বাধিকার-এর ২০ এপ্রিল ১৯৯৬ সংখ্যায়পি.পি.এস.পি.সি. পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নতুন অধ্যায়শিরোনামে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এই মুখোশদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়,

জন্মের পর থেকে সেনাবাহিনীর ঔরসজাত পিপিএসপিসি মুখোশধারীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষতঃ খাগড়াছড়িতে এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তারা সেনাবাহিনী পুলিশ প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সুপরিকল্পিতভাবে রাতের আঁধারে পাহাড়ি গণপরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হয়। তাদের আক্রমণের থাবা থেকে নিরীহ স্কুল শিক্ষক, সংবাদকর্মী ব্যবসায়ীরাও বাদ যাননি। মুখোশধারী গুণ্ডারা সেনাবাহিনীর নির্দেশে বেশ কয়েকজন পাহাড়ি গণ পরিষদ পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতাকর্মীকে অপহরণ করে, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রীদের লাঞ্ছিত করে তাদের বাড়ীঘরে হামলা চালায়। সন্ত্রাসীদের রিং মাস্টার মেজর মাহবুবের নির্দেশে খাগড়াছড়ি শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিকট থেকে তারা চিঠি দিয়ে বড় অংকের চাঁদা দাবী করে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না দিলেজানে শেষকরার হুমকি দেয়।

সেনা সৃষ্ট এই মুখোশদের উৎপাতে খাগড়াছড়ির জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। জনগণের পক্ষে পাহাড়ি বাঙ্গালীদের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি মুখোশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন। তারা দেশে সন্ত্রাস দমনের জন্য পুলিশ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় বাহিনী থাকা সত্ত্বেও সন্ত্রাস (?) দমনের জন্য আলাদাভাবে কমিটি গঠনের বৈধতার প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু জেলা প্রশাসন সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ঠ মুখোশ বাহিনীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। বরং প্রশাসনকে বিভিন্নভাবে এই সন্ত্রাসীদেরকে সহায়তা প্রদান করতে হয়েছে। এমনকি মুখোশ বাহিনী জেলা প্রশাসকের বাস ভবন আক্রমণ ভাঙচুর করলেও তিনি তাদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেননি। ফলে সাধারণ জনগণ নিজেরাই সংগঠিত হয়ে এই গণদুশমন মুখোশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য হন। জানুয়ারি ১৯৯৬ মুখোশদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ মদদ দান বন্ধ করার দাবিতে খাগড়াছড়িতে হাজার হাজার লোকের সমাবেশ মিছিল বের হয়। পাহাড়ি গণ পরিষদের তৎকালীন নেতা বিম্বিসার খীসাকে অপহরণ করা হলে জনতার প্রবল প্রতিবাদের মুখে সেনা সন্ত্রাসী মুখোশ বাহিনী তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ৭ই মার্চ গভীর রাতে মুখোশ বাহিনী আবার পেরাছড়ায় হানা দিতে গেলে হাজার হাজার জনতা তাদেরকে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসে। ফলে মুখোশরা সেনা বাহিনীর কড়া প্রহরায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই প্রতিরোধের সময় পুলিশের গুলিতে অমর বিকাশ চাকমা প্রাণ হারান। পানছড়িতেও এরা প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। স্বাধিকারের একই নিবন্ধে সম্পর্কে বলা হয়।

গত নভেম্বর৯৫ সন্ত্রাসী মুখোশধারীরা মাইক্রোবাস যোগে সশস্ত্রভাবে পানছড়িতে যায় এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ পাহাড়ি গণপরিষদের নেতা কর্মীদের ওপর হামলা করতে উদ্যত হয়। কিন্তু খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে এলাকার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসেন এবং মুখোশধারী গুণ্ডাদের ধাওয়া করে তাড়িয়ে দেন। ব্যাপক গণপ্রতিরোধের মুখে সন্ত্রাসীরা পানছড়ি থানায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। পুলিশ তাদের কাছ থেকে তিনটি পিস্তল কিছু রামদা উদ্ধার করে। কিন্তু এইসব সন্ত্রাসী মুখোশধারীদের গ্রেফতার করাতো দূরের কথা, খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমান্ডার এসপি সাহেবের কড়া নির্দেশে পুলিশ তাদেরকে রাত্রে অতিথির মতো আপ্যায়ন করার পর ভোর সকালে কড়া প্রহরায় খাগড়াছড়ি ব্রিগেড অফিসে পৌঁছে দিতে বাধ্য হয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই মুখোশ বাহিনী কেবলমাত্র তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার প্রশাসনের সাহায্য সহযোগিতা পায়নি, সে সময়ের সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও এই সন্ত্রাসীদের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন। যার ফলে তারা তাদের গণবিরোধী সন্ত্রাসী কার্যকলাপে আরো বেশী উৎসাহ পেয়ে যায়। এতেই বোঝা যায় ক্ষমতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি জামাতের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে দ্বন্দ্ব থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশ্নে তাদের মৌলিক নীতি এক অভিন্ন। কিন্তু মুখোশ বাহিনী সরকারী দল, বিরোধী দল, সেনাবাহিনী স্থানীয় প্রশাসনের সমস্ত ধরনের সমর্থন মদদ পাওয়া সত্ত্বেও ঐক্যবদ্ধ জনগণের দুঃসাহসিক প্রতিরোধের মুখে বিলীন হয়ে যায়। জুম্ম জনগণের গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজিত হয় এবং আপামর জনগণই ছিলেন এই অবিস্মরণীয় প্রতিরোধ যুদ্ধের আসল নায়ক।

বিভেদপন্থীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্র চক্রান্তের যেন শেষ নেই। সন্ত্রাসী মুখোশ বাহিনীকে দিয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ সহ তিন সংগঠনের নতুন ধারার গণ আন্দোলন স্তব্ধ করে দেয়ার সামরিক পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর সেনাবাহিনী তিন সংগঠনকে মোকাবিলার জন্য নতুন যড়যন্ত্রের জাল বুনে সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকে। এবং এক সময় তারা এক মোক্ষম সুযোগ পেয়েও যায়। শুরু হয় জুম্ম দিয়ে জুম্ম ধ্বংস করার নীল নক্সা বাস্তবায়নের ঘৃণ্য অপচেষ্টা। প্রত্যেক সমাজে বিভীষণ মীর জাফররা আন্দোলনের বুকে ছুরিকাঘাত হানার জন্য ঘাপটি মেরে বসে থাকে। রামায়ণে বিভীষণ যেমন বিশ্বাসঘাতকতা করে যুদ্ধরত তার স্বজাতির জনগণের পরাজয় নিশ্চিত করে দিয়েছিলেন, মীর জাফর যেমন সিংহাসনের লোভে সিরাজউদ্দৌল্লাহ্ বাংলার জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন যার ফলশ্রুতিতে সারা ভারতের স্বাধীনতার সূর্য স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল এবং ব্রিটিশরা দুই শত বছর ধরে ঔপনিবেশিক শাসন শোষণ জারী রাখতে সক্ষম হয়েছিল, সন্তু লারমা জেএসএস-এর নেতৃত্ব গোষ্ঠিও জুম্ম জনগণের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে সরকারের কাছে আত্মসমর্পন করলেন। ফলে সরকার সেনাবাহিনী মোক্ষম সুযোগটি পেয়ে যায় এবং তাদেরই বিশ্বস্ত খাদেম সন্তু লারমাকে দিয়ে তারা তাদের জুম্ম দিয়ে জুম্ম ধ্বংসের নীল নক্সা বাস্তবায়নে উঠে পড়ে লেগে যায়।

অর্থ কড়ি চাকরীর লোভে অনেক সুযোগ সন্ধানী, লম্পট ধান্ধাবাজও সন্তু লারমার সাথে জুটে যায়। প্রাক্তন মুখোশ বাহিনীর সদস্য দাগি আসামী মাস্তানরা তার বিশ্বস্ত দেহরক্ষী লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে নতুন নিয়োগ পায়। সরকার সেনাবাহিনীর কাছে যেমন তাদের জুম্ম বিধ্বংসী নীতি বাস্তবায়নের জন্য সন্তু লারমা অপরিহার্য, তেমনি আত্মসমর্পনের পর নতুন পরিস্থিতিতে নিজের পার্টির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সন্তু লারমারও সরকার সেনাবাহিনীর সমর্থন আর এসব সন্ত্রাসী, লম্পট, ধান্ধাবাজদের ওপর নির্ভর করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

বস্তুত আত্মসমর্পনের অনেক আগে থেকে আওয়ামী লীগ সরকার সন্তু চক্রের মধ্যে গোপন আঁতাত হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অধূনালুপ্ত শাস্তিবাহিনীর গোপন আস্তানায় গিয়ে সন্তু লারমার সাথে সাক্ষাত করেন। তাদের আলোচনায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদসহ তিন সংগঠনকে জব্দ করার এক গোপন পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এবং আত্মসমর্পনের সময় যাতে তিন সংগঠন বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য সন্তু লারমা তিন সংগঠনকে এবং বিশেষত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকে অকেজো করে দেয়ার হীন ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন। তিনি পিসিপি অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা সুবিধাবাদী সরকারী চরদের উস্কানি দিতে থাকেন, তাদেরকে কিনে নেয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেন এবং শেষ পর্যন্ত পুরো ছাত্র পরিষদকে কব্জা করতে ব্যর্থ হলে তাদেরকে দিয়ে চট্টগ্রামে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের দুই নাম্বারী সম্মেলন করিয়ে নেন।

দুই নাম্বারী বলে পরিচিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ থেকে বিতাড়িত এই সরকারী এজেন্টরা জনসংহতি সমিতির আত্মসমর্পনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়ার জন্য জনগণের মধ্যে বিভিন্ন আন্দোলন বিরোধী বক্তব্য প্রচার করতে থাকে। তারা বলে বেড়ায় যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় বোঝাপড়া করার এটাই মোক্ষম সুযোগ এবং এই সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত নয়। তারা এও বলে যে, আওয়ামী লীগ জুম্ম জনগণকে যা দেয় তা খুশী মনে মেনে নিতে হবে। কিন্তু পাহাড়ি ছাত্র পরিষদসহ তিন সংগঠন জনগণের নূন্যতম দাবি পূরণ না হলে কোন ধরনের সমঝোতা করার বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। ফলে জনসংহতি সমিতি এই সরকারী চররা তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে তিন সংগঠনকে চিহ্নিত করে। শুরু হয় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ অন্য দুই সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সন্তু চক্রের মিথ্যা প্রচারণা নির্যাতন। খাগড়াছড়িতে অনুষ্ঠিত পিসিপি সম্মেলনে অংশগ্রহণের কারণে সুবলং- শাস্তি প্রিয় চাকমা চন্দ্রমোহন চাকমাকে শান্তিবাহিনীর জনৈক সদস্য অমানুষিকভাবে শারীরিক নির্যাতন করে। তিন সংগঠনের পক্ষ থেকে এই ঘটনার কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে সন্তু লারমার কাছে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু যিনি সরকারের টোপ গিলে ফেলেছেন, তার কাছে প্রতিবাদলিপি ছিল অর্থহীন। কাজেই তিনি তার আত্মসমর্পনের পথ পরিষ্কার করতে একদিকে সরকারের সাথে লোক দেখানো আলোচনা অব্যাহত রাখেন, আবার অন্যদিকে তিন সংগঠনের ওপর ক্রমবর্ধমানভাবে চড়াও হতে থাকেন। পানছড়িতে প্রদীপ লাল, কুসুম প্রিয়, দেবোত্তম, রিংকু আরো অনেক পিসিপি পিজিপি নেতাকর্মী রাজনীতি করতে পারবে না বলে ফ্যাসিস্ট সন্তু লারমা একডিক্রি' জারি করেন এবং তাদের কয়েক জনকে বলপূর্বক সংগঠন থেকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। ১৯৯৭ সালের ১০ই নভেম্বর হুদুকছড়িতে লারমার মৃত্যুবার্ষিকী পালনের সময় শাস্তিবাহনীর সদস্যরা বন্দুক উঁচিয়ে ভয় দেখিয়ে বাধা দেয়। এক কথায় সন্তু লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতি এক নতুন মূর্তিতে আবির্ভূত হয়। হচ্ছে তার ফ্যাসিস্ট মূর্তি, বিভীষণ মীর জাফরদের প্রেতাত্মা।

১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর ঢাকায় সন্তু লারমা জুম্ম জনগণের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তিন সংগঠনের কোন প্রকার মতামত না নিয়ে সরকারের সাথে এক আপোষনামায় স্বাক্ষর করেন তথাকথিতশান্তিচুক্তিআখ্যা দেয়া এই আপোষচুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের মৌলিক দাবিগুলোর কোনটিই পূরণ হয়নি। তাই সংগত কারণে জনগণের পক্ষে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদসহ তিন সংগঠন সন্তু লারমার চুক্তি ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যান করে। প্রতিবাদস্বরূপ তার পরদিন অর্থাৎ ডিসেম্বর ঢাকার রাজপথে মিছিল বের করা হয় আপোষচুক্তির কপি পোড়ানো হয়।

১০ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ জুম্ম জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলংকিত একটি দিন। সন্তু লারমা এদিন খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে দেশী বিদেশী কূটনীতিক সাংবাদিকসহ হাজার হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে নির্লজ্জভাবে শেখ হাসিনার কাছে তার দলবল সহ আত্মসমর্পন করেন। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণ পরিষদ হিল উইমেন্স ফেডারেশন সন্তু লারমা চক্রের ধরনের বিশ্বাসঘাতকতার কড়া প্রতিবাদ জানায়। স্টেডিয়ামের ভিতরে আপোষচুক্তি প্রত্যাখ্যান করে ব্যানার কালো পতাকা প্রদর্শন করা হয় এবং শ্লোগান দেয়া হয়। সেখানে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনেরও দাবি জানানো হয়। দেশের সকল পত্র পত্রিকা সরকারী প্রচার মাধ্যম যখন চুক্তির গুণগানে মুখরিত, সরলপ্রাণ শান্তিকামী জুম্ম জনগণকে যখন সরকার জনসংহতি সমিতি বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত, ঠিক তখনই তিন সংগঠন প্রবল প্রতিকূল স্রোতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সত্য উচ্চারণ করতে উঠে দাঁড়ায়।

যুগে যুগে দেখা যায় যারা সত্য ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করেছেন তাদেরকে প্রথমদিকে অনেক নির্যাতন লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। পৃথিবী যে সূর্যের চারিদিকে ঘোরে তা কোপার্নিকাসই প্রথম আবিষ্কার করেন। কিন্তু তিনি এই সত্য কথাটি তার জীবৎকালে প্রচার করে যেতে পারেননি। সে সময় খৃষ্টান পাদ্রী যাজক সম্প্রদায়ের ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপ। কোপার্নিকাসের সত্য ছিল খৃষ্টীয় ধর্ম বাইবেলের বিরোধী। সে কারণে পাদ্রীরা ধর্মমতের বিরুদ্ধে কোন মতবাদ প্রচারকে সহ্য করতো না। কোপার্নিকাসের মত্যুর পর ব্রুনো একই সত্য আবিষ্কার করেন এবং তা প্রচার করেন। কিন্তু রক্ষণশীল গোঁড়া খৃষ্টান যাজক সাম্প্রদায় কারণে তাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। তাকে তার মত পরিবর্তন করে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। কিন্তু তিনি সত্যকে ধারণ করে বীরের মৃত্যুকেই বেছে নেন। বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকেও একই মতবাদ বিশ্বাস প্রচার করার জন্য নির্যাতন সহ্য করতে হয়। কিন্তু খৃষ্টান পাদ্রীদের বর্বর নির্যাতন সত্ত্বেও সত্যকে চাপা দেয়া যায়নি, পৃথিবী স্থির হয়ে থাকেনি। শুধু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নয়, রাজনৈতিক সত্য সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যও অনেক বিপ্লবীকে চরম নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। কাজেই দেখা যায়, সমাজ বিকাশের প্রক্রিয়ায় কোন এক নির্দিষ্ট সময়ে দুএক জনই প্রথমে সত্য দেখতে পান। তাদেরকে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। অনেক সময় জীবন দিয়েই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। ব্রুনোদেরকে তাদের সত্য নিয়ে পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধেই দাঁড়াতে হয়েছিল।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষিতে বলা যায়, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদসহ তিন সংগঠন যে সত্য আঁকড়ে ধরেছিলেন কালক্রমে তা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বর্তমানে এমনকি সন্তু লারমাও স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শাস্তি এখন কল্পনা বিলাস মাত্র ......... তারাও চুক্তি মানেন না ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু সত্য আঁকড়ে থাকার জন্য পাহাড়ি ছাত্র পরিষদসহ তিন সংগঠন পরে ইউপিডিএফ-এর ওপর অনেক দমন পীড়ন চালানো হয়েছে এবং এই দমন পীড়ন এখনো অব্যাহত রয়েছে। জনসংহতি সমিতির আত্মসমর্পনের পর পরই তিন সংগঠনের ওপর নির্যাতন বেড়ে যায়। তিন সংগঠনের বিরুদ্ধে জেএসএস, সরকার সেনাবাহিনী রঙবেরঙের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি একপবিত্রঐক্য গঠন করে। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ থেকে বহিষ্কৃত বিতাড়িত সরকারী এজেন্ট হিসেবে নিয়োজিত সুবিধাবাদীরাও এদের দলে ভিড়ে যায়। তারা সরকারের জুম্ম দিয়ে জুম্ম ধ্বংসের নীল নক্সা বাস্তবায়নে প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়। ফলে সন্তু লারমার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হন প্রথমে প্রদীপ লাল কুসুম প্রিয়। তাদেরকে দিন দুপুরে মধ্যযুগীয় কায়দায় পানছড়ির লতিবান নামক স্থানে খাগড়াছড়ি থেকে ফেরার পথে মোটর সাইকেল থেকে থামিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর ঠাকুরছড়ায় হরেন্দ্র-হুরুক্যা, দীঘিনালায় মৃণাল-আনন্দময়সহ আরো অনেককে খুন করা হয়। এই তালিকা ক্রমে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলেছে।

ইউপিডিএফ জেএসএস-এর কাছে নূন্যতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে এবং প্রথম থেকে আত্মঘাতি সংঘাত পরিহার করে রাজনৈতিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মতদ্বৈততা মীমাংসার আহ্বান জানিয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, ইউপিডিএফ জেএসএস-এর কাছে ঐক্যের ধরণ সম্পর্কে যে তিনটি প্রস্তাব দিয়েছে তার মধ্যে একটি হলো, জনসংহতি সমিতি ইউপিডিএফ-এর ওপর আক্রমণ বন্ধ করে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য কর্মসূচী ঘোষণা করুক, ইউপিডিএফ চুক্তি না মানলেও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সেই কর্মসূচীতে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেবে। ইউপিডিএফ-এর দিক থেকে এটা অত্যন্ত বড় ধরনের ছাড়। কিন্তু তা সত্ত্বেও জেএসএস-এর সন্তু লারমা চক্র ইউপিডিএফ তার সহযোগী সংগঠনগুলোর ওপর সশস্ত্র আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। এটা কি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে না যে, সন্তু লারমা চক্র আওয়ামী লীগ সরকারের জুম্ম বিধ্বংসী নীতি বাস্তবায়ন করছে? সন্তু লারমা চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনে রক্ত দেবেন বলে বার বার ঘোষণা দিয়ে আসছেন। ইউপিডিএফ- তার এই চুক্তি বাস্তবায়নের কর্মসূচীতে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইউপিডিএফ-এর সমর্থনের ফলে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সমগ্র জাতির ঐক্যবদ্ধ শক্তি দিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যেতো। কিন্তু তবুও কেন জেএসএস চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কোন কর্মসূচী গ্রহণ করছে না? তাহলে কি প্রমাণ হয় না তার রক্ত দেয়ার শপথ, চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের বিরুদ্ধে হুমকি সবই ভাওতাবাজি? এর মাধ্যমে কি এটা প্রমাণ হয় না যে, সন্তু লারমা আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য মোটেই আন্দোলনে উৎসাহী নয়? এটাও কি প্রমাণ করে না যে, সরকারের চাইতে ইউপিডিএফ-কেই সন্তু লারমা প্রধান শত্রু মনে করেন এবং চুক্তি বাস্তবায়নের চাইতে ইউপিডিএফ-কে নির্মূল করাই তার কাছে প্রধান? তিনি তাহলে কার স্বার্থ রক্ষা করছে। কার পক্ষে তিনি কাজ করছেন?

আসলে সন্তু লারমা আওয়ামী লীগ সরকারের দাসানুদাসে পরিণত হয়েছেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময়ও অনেক রাজনৈতিক দল ব্যক্তি বিশেষ বৃটিশ সরকারের পক্ষে কাজ করেছিল, তাদের স্বার্থের সেবা করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী রাজাকার আলবদর বাহিনী ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী শাসক শোষক গোষ্ঠির সেবা করেছিল সাধারণ জনগণের ওপর নিপীড়ন নির্যাতন চালিয়েছিল। বর্তমানে জেএসএস-এর সন্তু চক্রও আত্মসমর্পনের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা পালন করছে। সরকার সেনাবাহিনী অশিক্ষিত মুখোশদের দিয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ তথা জুম্ম জনগণের ন্যায়সংগত গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে দমন করতে ব্যর্থ হওয়ার পর বর্তমানে শিক্ষিত নব্য মুখোশদের দিয়ে জুম্ম দিয়ে জুম্ম ধ্বংসের জঘন্য খেলায় মেতে উঠেছে। কিন্তু ইউপিডিএফ-এর নেতৃত্বে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদসহ তিন সংগঠন এই নব্য মুখোশদের চেহারা খুলে দিয়েছে। অতীতে যেভাবে জনগণ তিন সংগঠনের সাথে কাঁধ মিলিয়ে কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে সেনাসৃষ্ট মুখোশদের প্রতিহত করেছেন, ঠিক একইভাবে ইউপিডিএফ তিন সংগঠনে নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংগ্রামী জনতা এই নব্য মুখোশ সন্তু চক্র সরকারী এজেন্ট বিভেদপন্থীদের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবেন।

উপসংহার: পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামে পিসিপি

পার্বত্য চট্টগ্রামে নয়া যুগের রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফ-এর নেতৃত্বে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদসহ তিন সংগঠন পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এই আন্দোলনের ফলে ইতিমধ্যে সন্তু চক্রের সকল ভন্ডামি তাদের গোলামী চুক্তির অসারতা প্রমাণিত হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এই আন্দোলন আরো ব্যাপক উত্তাল হতে বাধ্য। চুক্তির মাধ্যমে সন্তু লারমা তার দোসরদের মন্ত্রীত্ব আর্থিক ভাতা অন্যান্য সরকারী সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত হলেও জনগণের ভাগ্যের সামান্যতম পরিবর্তন হয়নি। বরং সন্তু লারমা চক্র বাংলাদেশ রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশে পরিণত হয়ে জনগণের ওপর বর্বর দমন পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং বর্তমান এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জুম্ম জনগণের অধিকার আদায় অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঐতিহাসিক দায়িত্ব অনিবার্যভাবে ইউপিডিএফ তার নেতৃত্বাধীন সংগঠনগুলোর ওপর এসে পড়েছে। লুঙুদু গণহত্যার শহীদদের রক্ত বীজ থেকে জন্ম নেয়া পিসিপি তার এই মহান দায়িত্ব পালনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। পৃথিবীর বুকে মানুষের মতো অধিকার মান মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সমগ্র জনগণকে নতুন করে ইউপিডিএফ-এর পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে। যারা তরুণ ছাত্র, যারা নিজের বিবেককে সরকার তার দালালদের কাছে বন্ধক দেননি, যারা গোলামী দাসত্বকে মনে প্রাণে ঘৃণা করেন- তারা আসুন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাথে যুক্ত হয়ে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের এক এক জন লড়াকু সৈনিক হয়ে যাই। বিজয় আমাদের অনিবার্য।

[এই লেখাটি ০০১ সালে প্রকাশিত পিসিপি'র একযুগপূর্তি স্মরণিকা "আমি বিদ্রোহী"-তে প্রকাশিত হেয়েছে ]

Post a Comment

أحدث أقدم